যে হাটে সব বিক্রেতাই নারী

কার্তিকের দুপুর। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে হাট জমে উঠতে শুরু করেছে। রাঙ্গামাটির লংগদু, বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ি জেলা সদরের চলাচলের প্রধান সড়ক এখানে এসে মিশেছে। তাই মানুষের ভিড়ও বেশি। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত এখানে হাট বসে। পাহাড়ে জুমে উৎপাদিত বিভিন্ন ফসল, বাঁশ কোড়ল, মিষ্টি কুমড়া, জঙ্গলের আলু, পেঁপে, বিভিন্ন জাতের কচু, হলুদ, আদাসহ অন্তত শতাধিক রকমের পণ্য উঠে এই হাটে। এছাড়া পাহাড়ি ছড়া ছোট মাছ, কাঁকড়া সবই মিলে এখানে।

দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে জমজমাট বেচাকেনা। তবে এ হাটের বিশেষত্ব হলো এখানকার বিক্রেতারা প্রায় সবাই নারী। পাহাড় বা প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন শাকসবজি বিক্রি করতে আসেন পাহাড়ের এ নারীরা। প্রচুর ক্রেতা জমায়েত হয় বলে বিক্রিও ভালো হয় বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

দীঘিনালার কামুইক্যাছড়া এলাকার ববিতা ত্রিপুরা বলেন, ‘এসময়ে তেমন কাজ থাকে না। তাই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জঙ্গলে গিয়ে বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ করেছি। সেটাই বিক্রি করতে আনলাম। প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিয়ে আসি। নিজের চাষের জমি নেই। পাহাড় থেকেই সংগ্রহ করা কচুশাক, ঢেকিশাক নিয়ে আসি। লারমা স্কয়ারে ক্রেতা সমাগম বেশি হয়। তাই এখানে বিক্রি করতে আসি। এখানকার সব বিক্রেতাই নারী। এটা ভালো লাগে।’

উপজেলার মায়াফা পাড়া এলাকার বাসিন্দা ললিতা ত্রিপুরা বলেন, ‘এখানে বেচাকেনা করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধকরি। যারা বিক্রেতা সবাই নারী। সপ্তাহের নির্দিষ্ট কোনো দিন নয়, এখানে প্রতিদিনই বেচাকেনা চলে। আজকে মিষ্টি কুমড়া ফুল আর পাহাড়ি আলু নিয়ে বিক্রি করতে এসেছি। এক ঘণ্টার মধ্যে সব বিক্রি হয়ে গেছে। দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়।’

হাটে সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন ধরনের সবজি নিয়ে লারমা স্কয়ারের হাটে আসেন নয় মাইল এলাকার বাসিন্দা কেলি ত্রিপুরা। তিনি বলেন, ‘এখানে ক্রেতা সমাগম বেশি হওয়ায় দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। পাহাড়ি বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা নারী বিক্রেতারা পাশাপাশি বসে সবজি, চাল, মরিচ, জঙ্গলের আলু, পাহাড়ি ছড়ার মাছ বিক্রি করেন। আয় ভালো জমে।’

হাটে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বাবুপাড়া এলাকার মনি চাকমা। তিনি বলেন, ‘হাটে নির্দিষ্ট স্থানে আমি প্রতিদিনই দোকান নিয়ে বসি। মূলত শাকসবজি, মরিচ, কুমড়া এসব বিক্রি করি। ভালো ক্রেতা সমাগম থাকায় দ্রুত বিক্রি হয়। দুপুরের পর থেকে হাটে ক্রেতা সমাগম বাড়তে থাকে। তবে সন্ধ্যার আগেই এখানে বেচাকেনা শেষ হয়ে যায়।’

লারমা স্কয়ারের হাট থেকে নিয়মিত কেনাকেটা করেন স্থানীয় বাসিন্দা সুমন নাথ। তিনি বলেন, ‘এখানে তুলনামূলক কম দামে টাটকা সবজি, ফলমূল, কাঁকড়া, ছোট মাছসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য পাওয়া যায়। তাই সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন এই হাটে আসা হয়। মূলত তাজা এবং বিষমুক্ত সবজি কম দামে পাওয়া যায় বলেই স্থানীয়দের কাছে এই হাট বেশ জনপ্রিয়।’

খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ও সভানেত্রী শেফালিকা ত্রিপুরা বলেন, ‘পাহাড়ের নারীরা ঘরে এবং বাইরে সমান পরিশ্রম করেন। তারা পরিবারের বাইরেও জুম চাষ করেন। এছাড়া অনেক নারী হাটে যান বেচাকেনা করে সংসারের জন্য আয় করতে। নারীদের এ এগিয়ে চলাটা সমাজের জন্য জরুরি বলে আমরা মনে করি।’

দীঘিনালার বোয়ালখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চয়ন বিকাশ চাকমা বলেন, ‘প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে লারমা স্কয়ারে হাট বসে। এখানে সব বিক্রেতাই নারী। তারা হাটে বেচাকেনা করে সংসারের হাল ধরেছেন। পাহাড়ের নারীরা পারিবারিক অর্থনীতিতে পুরুষের মতোই ভূমিকা রাখেন। ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে হাটে বেচাকেনা সবখানেই নারীদের উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। তার প্রমাণ এই হাট।’

LEAVE A REPLY