নির্বাচন কমিশনের লোগো।
কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দলের অংশ নেওয়া, না নেওয়ার প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের তফসিল পুনঃনির্ধারণের বিষয়টি সামনে এসেছে। বিশেষ করে গত রবিবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে পুনঃতফসিলের আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। আজ সোমবার নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানাও বলেছেন, বিএনপি অংশ নিলে আইন দেখে পুনঃতফসিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জাতীয় সংসদের গত তিন নির্বাচনেও সব দলের অংশ নেওয়া, না নেওয়ার দোটানায় তফসিল পরিবর্তন করা হয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটনাবহুল ছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০০৮)। এবার যেমন বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেবার এমন অবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ। নানা ঘটনার পরম্পরায় সেবার তফসিল ঘোষণার পর তিন দফায় তা সংশোধন করা হয়। অর্থাৎ তিনবার পুনঃতফসিল হয়।
মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ‘এক এগারো’ বইয়ে উল্লেখ আছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর তত্ববধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথগ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। এর প্রায় একমাস পর ২৬ নভেম্বর বঙ্গভবনে বৈঠক সেরে ২৭ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ভোটগ্রহণের তারিখ ঠিক করা হয় ২০০৭ সালের ২১ জানুয়ারি। এরপরই ১৪ দল জানিয়ে দেয় তারা এ তফসিল মানে না।
বিএনপি তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানায়।
রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কায় তফসিল ঘোষণার পরদিন ২৮ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়, রাজনৈতিক সমঝোতা হলে তফসিলে পরিবর্তন হতে পারে। বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের বিশেষ দূত ক্রেগ জেনেসও নির্বাচনের পরিবেশ ও রাজনৈতিক সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এর মাঝেই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল ডেমেক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) ২ ডিসেম্বর ঢাকায় এক জরিপের ফল প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ১ কোটি ২১ লাখ ভোটারই ভুয়া, যা মোট ভোটারের ১৩ শতাংশ।
সংঘাত ও নানামুখী অবস্থা বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন ৭ ডিসেম্বর সংশোধিত তফসিল ঘোষণা করে। এতে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২২ জানুয়ারি। অর্থাৎ, আগের তারিখের চেয়ে একদিন পেছানো হয়। সংশোধিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষদিন ছিল ২০০৬ সালের ২১ ডিসেম্বর। এর আগে ১৮ ডিসেম্বর পল্টনে ১৪ দলের জনসভায় জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও এলডিপি নিয়ে মহাজোটের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তফসিল বাতিল করে নতুন তফসিল ঘোষণার দাবি জানান। না হলে ২১ ডিসেম্বর সারা দেশে হরতাল পালনের হুঁশিয়ারি দেন। পরদিন ১৯ ডিসেম্বর পল্টনে জনসভা করে চারদলীয় জোট। এতে খালেদা জিয়া বলেন, সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্ববধায়ক সরকারের ৯০ দিন মেয়াদের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে।
মহিউদ্দিন আহমদের বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, এমন অবস্থায় ২০ ডিসেম্বর তফসিলে চতুর্থবারের মতো সংশোধন আনে কমিশন। তবে এবার ভোটগ্রহণের তারিখে কোনো পরিবর্তন করা হয় না। ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঠিক রেখে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় তিনদিন পিছিয়ে ২৪ ডিসেম্বর করা হয়। এরপর নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি নতুন করে তত্ত্ববধায়ক সরকার গঠন করা হয়। নতুন নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেনের বরাত দিয়ে করা বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএনপি তখনো নির্বাচনে আসবে কি না তা নিয়ে নিশ্চিত বার্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে দলটির সঙ্গে আলোচনার পর তাদের দাবির ভিত্তিতে নির্বাচনের তারিখ ১০ দিন পেছানো হয়। ভোটগ্রহণ হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর।
দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন
লাগাতার অবরোধ, নাশকতা আর সহিংসতার মধ্যেই ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর। সে রাতেই তফসিল প্রত্যাখ্যান করে রাজনৈতিক সমঝোতার দাবি জানায় বিএনপি (বিবিসি বাংলা, ৫ জানুয়ারি ২০২২)। তবে নির্ধারিত তারিখেই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন নিয়ে চলা মতপার্থক্য আর বিতর্কের মধ্যেই ২০১৮ সালের ৮ই নভেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (বিবিসি বাংলা, ১২ নভেম্বর ২০১৮)। ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ হয় ২৩ ডিসেম্বর। তখন নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সাত দফা দাবি জানায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে আওয়ামী লীগ ভোটের তারিখ পেছানোর বিরোধীতা করে। তিনদিন পর ঘোষিত পুনঃতফসিলে ভোটের তারিখ নির্ধারণ হয় ৩০ ডিসেম্বর।
পুনঃতফসিলের ক্ষমতা
ঘোষিত তফসিল সংশোধনের এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের আছে। সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী দায়িত্ব পালন করিবেন।’
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এক অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, কমিশন চাইলে তফসিলের সংশোধন ও নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করতে পারে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা আছে। এই সময়ের মধ্যে ভোটগ্রহণের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে, প্রয়োজন অনুযায়ী সেটি পরিবর্তন করা যাবে।