পুলিশ বক্সে আগুন গুলি

ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের প্রতিবাদে রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে। রিকশাচালকদের বিক্ষোভ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে মিরপুর-১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর সেকশন এবং কালশী এলাকায়। এছাড়া ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, জুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকায়ও বিক্ষোভ করেন চালকরা। 
এসব এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের সঙ্গে রিকশাচালকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিক্ষুদ্ধ চালকরা বেশকিছু বাস, ট্রাক ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন। কালশী পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। যাত্রাবাড়ীর গোলাপবাগ ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও সায়েদাবাদ জনপথ মোড় পুলিশ বক্স ভাঙচুর হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জের পাশাপাশি টিয়ার শেল এবং রাবার বুলেট ছোড়ে। 

এতে বিক্ষোভরত তিন রিকশাচালক আহত হন। গুলিবিদ্ধ হন এক পথচারী। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চালকদের দাবি, হুট করে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তে তাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য তারা রাজপথে নেমেছেন। এ ঘটনায় দিনভর মিরপুরজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করে। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকে এ এলাকায় যান চলাচল। 

স্থানীয় সংসদ-সদস্য এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা চালান। সংসদ-সদস্যের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে রিকশাচালকরা একে একে রাজপথ ছাড়তে থাকেন। সন্ধ্যার দিকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। শুরু হয় যান চলাচল। 

ডিএমপির মিরপুর বিভাগের ডিসি জসিম উদ্দিন মোল্লা বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অটোরিকশাচালকরা তাণ্ডব চালিয়েছেন। তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে অন্য কোনো লোকজনও জড়িত থাকতে পারে। তবে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। যারা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

পথচারী গুলিবিদ্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। রোববার সকাল ১০টার পরে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে অবস্থান নেন ব্যাটারির রিকশাচালকরা। ব্যাটারির রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান তারা। একপর্যায়ে রাস্তায় অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এরপর ধীরে ধীরে অরিজিনাল-১০, ১১ নম্বর এবং ১২ নম্বর এলাকার প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েন তারা। অন্যদিকে কালশী ও পল্লবী এলাকার ব্যাটারির রিকশাচালকরা অবস্থান নেন কালশী মোড়ে। তারা কালশী ফ্লাইওভার ও নিচের অংশে ব্যারিকেড দেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় ওই সড়কের যান চলাচল। 

সরেজমিন দুপুর সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে দেখা গেছে, বিক্ষুব্ধ কয়েকশ চালক লাঠি হাতে অবস্থান করছেন। তাদের বাধা ডিঙিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী কিংবা সিএনজিচালক এগোতে চেষ্টা করলেই তাকে তারা লাঞ্ছিত করেন। পুলিশ সতর্ক অবস্থানে থাকলেও তাৎক্ষণিক কঠোর হতে দেখা যায়নি। 

মিরপুর-১০ নম্বরে মেট্রোরেল স্টেশনের গেটের পাশেও অবস্থান করতে দেখা যায় রিকশাচালকদের। এ সময় বন্ধ হয়ে যায় মেট্রোরেলের দুইপাশের গেট। এমআরটি পুলিশ ছিল সতর্কাবস্থানে। মিরপুর-১০ নম্বরের পাশাপাশি ১১ এবং ১২ নম্বর এলাকায়ও সড়কে জড়ো হন রিকশাচালকরা। তাদের অবস্থানের কারণে ওই এলাকার সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অনেককে বাস থেকে নেমে রোদের মধ্যে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা যায়।

দুপুর পৌনে ১২টায় ওই এলাকায় রিকশাচালক আল আমিন যুগান্তরকে বলেন, হঠাৎ করে ব্যাটারির রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের সংসারের চাকা অচল হয়ে যাচ্ছে। এই কারণে আমরা সবাই একত্রিত হয়ে রাস্তায় নেমেছি। 

বিকাল পৌনে ৩টার দিকে আন্দোলনরত চালকদের সঙ্গে কথা বলতে মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় যান ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ-সদস্য ইলিয়াস মোল্লা। তিনি আন্দোলনকারীদের সড়ক ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন এবং রিকশা চলাচলের বিষয়ে আলোচনার আশ্বাস দেন। তার আশ্বাসে চালকদের একটি অংশ আন্দোলন শেষ করে ফিরতে সম্মত হন। তবে শেওড়াপাড়ার দিক থেকে আসা রিকশাচালকরা লাঠি হাতে হই-হুল্লোড় করে এসে আবারও অবরোধ শুরু করেন। 

এ সময় পুলিশ তাদের সরানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং লাঠি নিয়ে ধাওয়া দেন। পুলিশও তাদের পালটা ধাওয়া করে। কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, রাবার বুলেট ব্যবহার করে। 
সব মিলিয়ে আতঙ্ক ছড়ায় পুরো মিরপুরে। বিকাল ৪টার দিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার সড়ক থেকে সরিয়ে দিলে তারা অবস্থান নেন আশপাশের গলিতে। থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে চারদিকে। এরপর এই এলাকার বিভিন্ন সড়কে থেমে থেমে যান চলাচল শুরু হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এই এলাকায় বেশ কয়েকটি বাস ভাঙচুর করেছে বিক্ষোভকারীরা। 

সকাল থেকে পল্লবী, ইসিবি এলাকার রিকশাচালকরা একত্রিত হয়ে কালশী এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। তারা কালশী ফ্লাইওভারেও ব্যারিকেড দেন। এতে ফ্লাইওভারে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন এসব পরিবহণের যাত্রীরা। কালশী এলাকায় সকাল থেকেই লাঠি হাতে সহিংস হয়ে উঠতে দেখা যায় রিকশাচালকদের। তাদের অভিযোগ, হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার রিকশাচালক। পরিবার নিয়ে এখন তারা চরম বিপাকে পড়েছেন। 

দুপুর ২টার দিকে তারা একজন মোটরসাইকেল চালক এবং একজন সিএনজি চালককে মারধর করেন। বেলা ৩টার পর মিরপুরে সংঘর্ষের খবরে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন তারা। এসময় পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চাইলে দুপক্ষে ধাওয়া-পালটাধাওয়া শুরু হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে রিকশাচালকরা ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। 

পুলিশ তাদের দমাতে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেট ছোড়ে। এই অবস্থায় বিকাল সোয়া ৪টায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কালশী মোড়ে দুটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে বিকাল সোয়া ৫টার দিকে বিক্ষোভকারীদের মূল সড়ক থেকে সরিয়ে দেয় পুলিশ। এরপর রিকশাচালকরা অবস্থান নেন আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়। এরপর সন্ধ্যার দিকে এ এলাকার সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে। 

কালশীতে ধাওয়া-পালটাধাওয়ার মাঝে পড়ে সাগর চকদার (২৫) নামে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট তার বুকে এবং গলায় বিদ্ধ হয়েছে। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি মিরপুর ১১ নম্বর এলাকার একটি দর্জি দোকানের কারিগর। জানা গেছে, বন্ধু রাকিবুলকে নিয়ে তিনি উত্তরা থেকে ফিরছিলেন। অবরোধের কারণে ইসিবিতে নেমে হেঁটে মিরপুরের বাসায় যাচ্ছিলেন। কালশী এলাকায় পৌঁছালে তারা ধাওয়া-পালটাধাওয়ার মাঝখানে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন। 

মিরপুর প্রতিনিধি জানান, সন্ধ্যার পরও মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পুলিশ রায়ট কার, জলকামানসহ সরঞ্জামাদি নিয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কেউ যাতে কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটাতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে তারা। সন্ধ্যার দিকে কালশী এলাকায় গিয়ে রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলেছেন স্থানীয় সংসদ-সদস্য।

যাত্রাবাড়ী প্রতিনিধি জানান, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী ও জুরাইন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন চালক ও মালিকরা। রোববার যাত্রাবাড়ী মোড়, সায়েদাবাদ জনপথ মোড়, গোলাপবাগ মোড়, ঢাকা-মাওয়া সড়কের জুরাইন ও ঢাকা-ডেমরা সড়কের কাজলারপাড়, কদমতলীর বর্ণমালা স্কুল রোডে বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা। বিক্ষোভকারীরা গোলাপবাগ ট্রাফিক পুলিশ বক্স, সায়েদাবাদ জনপথ মোড় পুলিশ বক্স ভাঙচুর করেছেন। 

এছাড়া একজন সার্জেন্টের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেছেন তারা। তাছাড়া বিভিন্ন অটোরিকশা ভাঙচুর করা হয়। অবরোধের কারণে ওইসব এলাকার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। 
ডেমরা : ডেমরা প্রতিনিধি জানান, সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় ডেমরা-যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা-রামপুরা সড়ক অবরোধ করে রাখেন চালকরা। এ সময় লাঠিসোঁটা হাতে নিয়েও চালকেরা ওই দুটি সড়কে অন্যান্য পণ্য ও যাত্রীবাহী সব যান চলাচল বন্ধ রাখেন। এতে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। 

১৫ মে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে না দেওয়ার নির্দেশ দেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বনানীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কার্যালয়ে সড়ক পরিবহণ উপদেষ্টা পরিষদের সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন। সেতুমন্ত্রী বলেন, ঢাকায় কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো যাবে না। এ বিষয়ে শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপ নয়, এগুলো চলতে যেন না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ২২ মহাসড়কে রিকশা ও ইজিবাইক নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করুন। এ প্রেক্ষিতেই ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে পুলিশ।

LEAVE A REPLY