জাদুর বাঁশিতে বারবার বশ মানে দুদক

জাতীয় রাজস্ব রোর্ডের সদস্য মো. মতিউর রহমান যেন জাদুর বংশীবাদক। তার বাঁশির সুরে বারবার বশ মেনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি ১২ লাখ টাকার ছাগলকাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত উচ্চপদস্থ এই সরকারি কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে গত ১৮ বছরের ব্যবধানে চার দফা টিম গঠন করা হয়। রহস্যজনকভাবে প্রতিবারই অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে তাকে দেওয়া হয় ‘ক্লিনচিট।’ এ নিয়ে সংস্থার ভেতরে-বাইরে নানা গুঞ্জন রয়েছে। তবে এবার মতিউরের বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধানের জন্য টিম গঠনের শক্ত সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে সংস্থাটির যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক)। গত ৪ জুন অনুষ্ঠিত যাবাকের সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

জানা গেছে, ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ এই দুই বছর বেনাপোল বন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার ছিলেন মতিউর রহমান। তৎকালীন সময়েই তার বিরুদ্ধে বেপরোয়া ঘুস ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেখানকার একজন ব্যবসায়ী জানান, তৎকালীন সময়ে বেনাপোল বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণে সিগারেট তৈরির কাগজ আমদানি হতো। মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে কাগজ আমদানিতে ব্যবসায়ীদের অনৈতিক সুবিধা দিতেন মতিউর। এতে প্রতি ট্রাক কাগজ ছাড় করাতে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হতো অন্তত অর্ধকোটি টাকা। সুবিধাভোগীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যশোরের ঝিকরগাছার সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী নাজমুল ইসলাম। কিন্তু এক পর্যায়ে ঘুসের অঙ্ক নিয়ে তার সঙ্গে মতিউরের বিরোধ বাধে। তখন মতিউর রহমান নাজমুলের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে থানায় মামলাও করেছিলেন। দুই বছর দায়িত্ব পালনকালে বেনাপোল বন্দর থেকেই তিনি অঢেল কামিয়েছিলেন। সেখান থেকেই মূলত তার ‘অবৈধ আয়ের’ হাতেখড়ি বলে জানা গেছে।

অভিযোগ আছে, কাস্টমসের সহকারী কমিশনার থেকে বর্তমানে এনবিআর সদস্য হয়েছেন তিনি। আর এর মধ্যেই তিনি নামে-বেনামে, দেশে-বিদেশে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। এসব সম্পদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর দুদক তার বিরুদ্ধে প্রথম অনুসন্ধান টিম গঠন করে ২০০০ সালের দিকে। তখন দীর্ঘ সময় অনুসন্ধান ঝুলিয়ে রেখে ২০০৪ সালে অভিযোগ পরিসমাপ্তি করা হয়। এরপর একই কায়দায় ২০০৮, ২০১৩ ও ২০২১ সালে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে তাকে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়। ফলে দুদকের ভেতরেই গুঞ্জন ওঠে মতিউর এক জাদুর বংশীবাদক। তার পাগল করা বাঁশির সুরে সব অনুসন্ধান টিমের সদস্যই বশ মেনেছেন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, মতিউর রহমান শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে অন্যতম একজন। বাজারসংশ্লিষ্টদের কাছে তার পরিচয় ‘গেমলার’ হিসাবে। তার সঙ্গে দুদকের অনেক কর্মকর্তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকায় তিনি পার পেয়ে যান।

জানা গেছে, সবশেষ গত ৪ জুন যাবাকের আহ্বায়ক দুদক মহাপরিচালক মো. মোকাম্মেল হক সভায় উপস্থাপন করেন, এনবিআর সদস্য মো. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সভায় আরও জানানো হয় যে, একই ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধানপূর্বক চারবার পরিসমাপ্ত করা হয়। সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ একটি টিম গঠনপূর্বক প্রকাশ্যে অনুসন্ধান করার বিষয়ে কমিশন একমত পোষণ করে। সভায় একটি টিম গঠন করে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়, পরিসমাপ্তিকৃত চারটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও তৎসংশ্লিষ্ট নথি খুঁজে বের করতে হবে। নথি খুঁজে না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার দায়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘আগে পরিসমাপ্তি হলে যে নতুন করে ফের অনুসন্ধান করা যাবে না তার বিধান নেই। কাজেই এখন নতুন করে যেহেতু বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে সেহেতু আমরা আশা করব দুদক তো বটেই, সরকারের অন্যান্য সংস্থাও বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে।’

LEAVE A REPLY