অর্থ পাচারে জড়িত ১৭ মন্ত্রী-এমপি ও ৫ ব্যবসায়ী

বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরাতে জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকের সময় পাচার করা টাকা ফেরাতে সহায়তা চাইছেন। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থসম্পদ সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন দেশে চিঠি দেওয়া শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী সাবেক ৮ মন্ত্রী, ৯ সংসদ-সদস্য (এমপি) এবং তাদের স্ত্রী, সন্তান ও সহযোগীদের নামে অর্থসম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে।

এছাড়াও ৫টি বড় ব্যবসায়িক গ্রুপের নামে বিদেশে থাকা অর্থসম্পদের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও রাজনৈতিক নেতা, ব্যাংকার, আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী-তাদের গ্রুপের নামও আছে অর্থসম্পদের তথ্য চাওয়ার তালিকায়। দেশে তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে বিদেশে সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। টানা ১৫ বছরে তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে সরকার ক্ষমতায় টিকে ছিল। ওই সময়ে দেশের আর্থিকসহ প্রায় সব খাতেই নজিরবিহীন লুটপাট করে টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এ কাজে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য (এমপি), আমলা ও ব্যবসায়ীরা ছিলেন সামনের সারিতে। যে কারণে পতনের পর সরকারের মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য ও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীদের একটি অংশ পালিয়ে গেছে। ওইসব ব্যক্তি এবং তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে টাকা পাচারের তথ্য অনুসন্ধান চলছে।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করা অর্থের বড় অংশই যাচ্ছে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ আরও কিছু দেশে। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে সহায়তা চেয়েছেন। তারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সহায়তা করতে চান। এছাড়া আরও কয়েকটি দেশের কাছে সহায়তা চাওয়া হবে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত ও পর্যবেক্ষণে সরকারের ৮ জন সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। এর ভিত্তিতে বিএফআইইউ থেকে তাদের এবং তাদের স্ত্রী, সন্তান ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানির নামে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। তাদের সঙ্গে প্রত্যেকের স্ত্রী, সন্তান, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করে বিদেশে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে তাদের নামে স্থাবর ও অস্থাবর কোনো সম্পদ থাকলে তা জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।

প্রাথমিক তদন্তে বেশ কয়েকজন সংসদ-সদস্যের নামেও বিদেশে অর্থসম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এর আলোকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৯ সংসদ-সদস্যের নাম উল্লেখ করে বিদেশে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সংসদ-সদস্য শামীম ওসমান, তার ভাই ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি, জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ-সদস্য ও ব্যবসায়ী সেলিম ওসমান। তাদের সঙ্গে স্ত্রী, সন্তান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করা হয়েছে বিএফআইইউ-এর চিঠিতে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত, শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং বেক্সিমকো গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামেও বিদেশে তথ্য চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তার ছেলে ও আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমানেরও তথ্য চাওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক সভাপতি ও কিশোরগঞ্জের (ভৈরব) সংসদ-সদস্য নাজমুল হাসান পাপন এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামেও বিদেশে অর্থসম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে।

সাবেক সংসদ-সদস্যদের মধ্যে আরও আছেন জামালপুর-৩ আসনের মির্জা আজম, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের জান্নাত আরা হেনরী, ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, নাটোর-২ আসনের শফিকুল ইসলাম শিমুল ও পিরোজপুর-১ আসনের মহিউদ্দিন মহারাজ। সাবেক সংসদ-সদস্যদের প্রত্যেকের স্ত্রী, সন্তান, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থসম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে।

এছাড়াও দেশে দুর্নীতি ও সরকারি সুবিধা নিয়ে অর্থ লুটপাট করার দায়ে বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ৫টি ব্যবসায়িক গ্রুপ ও তাদের কর্ণধার এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে বিদেশে থাকা অর্থসম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়িক গ্রুপ ও ৬টি ব্যাংক দখলকারী এস আলম গ্রুপ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সামিট গ্রুপ, ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন নাসা গ্রুপ, আর্থিক খাতে বহুল আলোচিত নাম চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামেও তথ্য চাওয়া হয়।

এর বাইরে রয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের বরখাস্তকৃত উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন। বাংলাদেশে তার হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ। তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৪ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৯৯ কোটি টাকা জমার হদিস মিলেছে। এ কারণে তার নামেও তথ্য চাওয়া হয়েছে।

আরও রয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রীর সহযোগী ও সিটিজেন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান তৌফিকা আফতাব। পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদের নামেও তথ্য চাওয়া হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার নামেও বিদেশে তথ্য চাওয়া হয়।

সূত্র জানায়, বিএফআইইউ এসব তথ্য সংগ্রহ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাকে সরবরাহ করবে। তারা নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্র অনুযায়ী তদন্ত করবে। ইতোমধ্যে সংস্থাগুলো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে কাজ শুরু করেছে।

বিএফআইইউসহ অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রাথমিক তদন্তে আলোচ্য ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর নামে দেশে-বিদেশে বিপুল অঙ্কের অর্থসম্পদের সন্ধান মিলেছে। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত। এসব অর্থের একটি অংশ তারা বিদেশে পাচার করেছেন। যে কারণে এখন বিদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য চাওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিএফআইইউ ওইসব ব্যক্তির নামে বিভিন্ন দেশে থাকা অর্থসম্পদের তথ্য চেয়েছে মানি লন্ডারিং নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা এগমন্ট গ্রুপের কাছে। বাংলাদেশ এগমন্ট গ্রুপের সদস্য। বিশ্বের ১৭৭টি দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটগুলো এই গ্রুপের সদস্য। বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হচ্ছে, সেসব দেশও এই গ্রুপের সদস্য। এই গ্রুপের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দেশ তথ্য চাইলে তারা সংশ্লিষ্ট সদস্য দেশগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে বিএফআইইউ অনেক ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করেছে। এছাড়া বিএফআইইউ ৮১টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এর আওতায় দেশভিত্তিক তথ্য সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে।

বিএফআইইউ থেকে আরও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তাদের বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেলেই তাদের বিষয়েও বিদেশে অর্থসম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হবে।

LEAVE A REPLY