সারা জীবন সিনিয়রদের কাছ থেকে বাধা পেয়েছি

সুজিত মোস্তফা

নজরুলসংগীত শিল্পী ও গবেষক সুজিত মোস্তফা। নজরুলসংগীত শিল্পী পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন ১ জানুয়ারি থেকে। কাজ করছেন আরো অনেক কিছু নিয়ে।

কেমন আছেন?

ভালো আছি।

হাতে অনেকগুলো কাজ নিয়েছি, একটু চাপ পড়ে যাচ্ছে। বয়স এবং শরীরটাও তো দেখতে হবে।

কী কী কাজ হাতে নিয়েছেন জানতে পারি?

আমাদের শিল্পীদের দল বেঁধে বসার কোনো জায়গা ছিল না। কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় সেটা করার উদ্যোগ নিয়েছি।

একটা প্ল্যাটফরম দাঁড় করিয়েছি। আর্টিস্ট ক্লাব লিমিটেড নামের একটা ক্লাব করেছি বনানীর জে ব্লকে। প্রতি সপ্তাহে সেখানে একটা সংগীতানুষ্ঠান করি। ১০১ জন ফাউন্ডার মেম্বার নিয়ে ক্লাবটি শুরু করেছি।

ধীরে ধীরে সব সেক্টরের শিল্পীদের এখানে সদস্য করা হবে। অন্যান্য ক্লাবের মতো আমাদের ক্লাবেও সব ধরনের সুবিধা থাকবে। শিল্পীরা তো বরাবরই বঞ্চিত, তাদের সম্মান নেই, সম্মানি নেই। তারা অবহেলার পাত্র। আমরা এই খাদ থেকে শিল্পীসমাজকে উত্তরণের চেষ্টা করব।

এ ছাড়া আমি বেশ আগে জাতীয় কবিকে নিয়ে একটা পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেছিলাম, নাম ‘চক্রবাক’। ১৪টি সংখ্যা করতে পেরেছি মাত্র। জানেন তো, আমাদের দেশে ভালো কাজে সহযোগিতা পাওয়া যায় না। ফাইন্যান্সের অভাবে ২০১২ সালে সেটার প্রকাশ বন্ধ করি। এখন পত্রিকাটি আবার বের করার উদ্যোগ নিয়েছি। হার্ডকপি ও অনলাইন সংস্করণ পাওয়া যাবে। দু-একজন আর্থিক সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছেন।

 জানুয়ারি থেকে নজরুলসংগীত শিল্পী পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। সংগঠনটির কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনা করেছেন?

আমাদের এই সংগঠনের প্রধান কাজ নজরুলের গান প্রকাশ ও প্রসারিত করা। কাজী নজরুলের যে ১২টি দর্শন আছে, সেগুলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তিনি যে মানবতার কথা বলেছেন, সাম্যবাদের কথা বলেছেন, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন—সেগুলো আমরা মানুষের সামনে নতুন করে তুলে ধরব। তার দর্শন, চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে দিয়ে নতুন প্রজন্মকে নজরুলে উদ্বুদ্ধ করতে চাই। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যারা নজরুলপ্রেমী আছেন, তাদের সামনে নিয়ে আসব।

অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সংস্কার নিয়ে কাজ করছে। সংস্কৃতিতে সংস্কারের বিষয়ে আপনার কোনো মতামত আছে কি?

সংস্কার আসলে মানুষ না বদলালে হবে না। সংস্কার মানে কি এক জায়গার মানুষকে আরেক জায়গায় বদলি করা? একই মানুষ থাকলে তো যেখানেই যাবে আগের মতো আচরণ করবে, কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সংস্কার করতে চাইলে শিশুদের থেকেই শুরু করতে হবে। আমি একটা উদ্যোগও নিয়েছি। সততা, শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, পশুপ্রেম, মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম প্রভৃতি নিয়ে গান তৈরি করছি। এর মধ্যে সাতটি গান শেষ হয়েছে। ইচ্ছা আছে ৩০টি গান তৈরি করার। গানগুলো শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই শিগগিরই। সংগীত একটা শিল্প। কথা, সুর ও ছন্দ দিয়ে শিশুদের কোমল মনে সঠিক কর্ম তুলে দিতে পারলে সেই কর্মের স্থায়ী প্রভাব পড়বে।  এটা সংগীতের একটা বিশেষ চরিত্র। এর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে মননশীলতা তৈরি হবে।

তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে অনেকে বলেন, আগেই ভালো ছিল। আসলে কি তাই?

প্রযুক্তিকে অস্বীকার করার তো কিছু নেই। প্রযুক্তি কি মানুষের আয়ু বাড়ায়নি? আজ মানুষ কিডনি পরিবর্তন করছে, হার্টের ভাল্ভ পরিবর্তন করছে, ক্যান্সারও জয় করছে—সবই তো প্রযুক্তির কারণে। তবে হ্যাঁ, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারটা জানতে হবে। এই যে ফসলে সার ব্যবহার করে উৎপাদন দ্বিগুণ করা হচ্ছে, এটা না করে তো উপায়ও নেই! বাংলাদেশে যে পরিমাণ মুরগির মাংসের চাহিদা আছে, শুধু দেশি মুরগি দিয়ে কি সেটা মেটানো সম্ভব? না। ফলে ফার্মের মুরগিও উৎপাদন করতে হচ্ছে, বাজারজাত করতে হচ্ছে। ওই যে বললাম, প্রযুক্তিকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই, তবে সঠিক ব্যবহারটা করতে হবে। যে পারমাণবিক বোমা দিয়ে হিরোশিমা ধ্বংস করা হয়েছিল, সেই পারমাণবিক শক্তি দিয়েই কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।

অনেক প্রবীণ শিল্পী এই সময়ের শিল্পীদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন। অথচ আপনি ঠিক উল্টো। কারণটা কী জানতে পারি?

আমার বাবা শিখিয়েছেন, নিজের জ্ঞান লুকিয়ে রাখতে নেই। মানুষকে সহযোগিতা করতে হয়। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সেটা করি। নতুনদের সামনে এগিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করি। সত্যি বলতে, আমি সারা জীবন সিনিয়রদের কাছ থেকে বাধা পেয়েছি। এটা আমাকে বারবার হতাশ করেছে। আমি স্তম্ভিত হয়েছি। তাই নতুনদের বেলায় আমার ক্ষেত্রেও যেন সেটা না হয়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকি। যারা ভালো করছে তাদের উৎসাহিত করি।

অনেকে মনে করেন, নজরুলসংগীত চর্চা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আপনি কী মনে করেন?

নজরুলের ফিলোসফি তো বুঝতে হবে আগে। তিনি অসংখ্য গান দিয়ে গেছেন, সেই গানগুলো গেয়ে শিল্পী হিসেবে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব। তবে এমন চাহিদাসম্পন্ন নজরুলসংগীত শিল্পী এখন কই? গ্রামোফোন রেকর্ডে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল ছিল নজরুলসংগীত। অথচ তার গানের চাহিদা এখন পড়ে গেল কেন? একটা সময় নজরুলসংগীত গেয়েছিলেন ক্ষমতাশালী কণ্ঠের অধিকারী শিল্পীরা। উপমহাদেশীয় শিল্পীরা ছাড়াও সুবীর নন্দী, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর মতো শিল্পীরাও বিতর্কের মুখে একটা সময় নজরুলসংগীত এড়িয়ে গিয়েছেন। এতে কিন্তু তাদের ক্যারিয়ারের ক্ষতি হয়নি, হয়েছে নজরুলসংগীতের ক্ষতি। মোহাম্মদ রফি, অনুপ জলোটা, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়রা দাপটের সঙ্গে নজরুলসংগীত করেছেন। তাদের নিয়েও বিতর্ক হয়। এটা করে মাঝারি মাপের শিল্পীরাই। আমরা আসলে দিন দিন বই পড়া, ভালো সিনেমা দেখা ভুলে যাচ্ছি। ভুলে যাচ্ছি রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে। এটার প্রভাব খুব খারাপ হবে। দেখেন, বড় বড় যে করপোরেট শোগুলো হয়, সেখানে ডাকা হয় ধামাকা গানের শিল্পীদের। সিরিয়াস গানের শিল্পীদের কথা বলতে গেলেই বলে, বাজেট নেই। তাহলে কিভাবে নজরুলসংগীত বেঁচে থাকবে! আমি নিজেই তো বলতে গেলে সরকারি শো পাই না, সরকারের তরফ থেকে দেশের শোতেও যেতে পারি না। নজরুলসংগীতকে তাহলে বিশ্বব্যাপী কিভাবে তুলে ধরব?

নজরুলসংগীত বা রবীন্দ্রসংগীতকে এখনো কি পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ আছে?

আমার তো সন্দেহ হয়, ভবিষ্যতে নজরুল বা রবীন্দ্রসংগীতকে কেউ পেশা হিসেবে নিতে চাইবে কি না! এখন ইউটিউবের যুগ, ফেসবুকের যুগ। এ ছাড়া প্রত্যেকের হাতে হাতে মোবাইল। সবাই পারফরমার। শর্টস, রিল, ভ্লগ, টিকটক করেই সবাই আয় করছে। বাহবা কুড়াচ্ছে, কেউ কেউ তারকাও হয়ে যাচ্ছে। তাহলে আর কষ্ট করে গান শেখা বা চর্চা করে শেখার প্রয়োজন কী? মানুষ এখন শিল্পী হওয়ার চেয়ে ইউটিউবার, ফেসবুকার, ডিরেক্টর হওয়ার চেষ্টায় আছে। এখন যে পরিমাণ ওটিটি প্ল্যাটফরম আছে, তাতে মানুষের তো হলে যাওয়ার প্রবণতাও কমেছে। ঘরে বসেই দেখতে পারছে সব। নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত তো অনেক সাধনার। ফলে সিরিয়াস গান শিখতে চায় না কেউ। আর সহজে যেটা পাওয়া যায় সেদিকেই তো ঝুঁকবে সবাই।

আপনার বাবা বিশিষ্ট গীতিকার, শিক্ষাবিদ ও কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তার সঙ্গে কোনো স্মৃতি যদি ভাগাভাগি করতেন…

আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই-বোন। আমার মনে হয় বাবা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন গান করতাম বলে। আমার ১২টি গানের একটি ক্যাসেট বাবা বুকপকেটে নিয়ে ঘুরতেন। যখনই অবসর পেতেন, নিজে শুনতেন, বন্ধুদেরও শোনাতেন। তবে আমার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশটা কিন্তু সেভাবে করতেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান মানুষ। বাবা যখন বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলার দায়িত্ব পেলেন, আমার কিন্তু সেখানে যাওয়া নিষেধ ছিল। একবার একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সুজিত তো ভালো গায়, ওকে কেন ডাকছেন না!’ বাবা বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে তো আগে থেকেই ভালো গায়, এত দিন কেন ডাকেননি। আমি দায়িত্বে আসার পর কেন ডাকছেন? আমি থাকাকালে এখানে সুজিত মোস্তফার পায়ের ছাপ যেন না পড়ে।’ তবে একবার এক প্রবীণ শিল্পী হুমকি দিয়েছিলেন, সুজিত কোনো স্টেজে গান করলে মরতে হবে। কথাটা শুনে বাবা বুঝতে পারলেন, আমার জীবন সংশয় আছে। তবে তিনি চ্যালেঞ্জটা নিলেন। মৃত্যুর আগে শেষ অনুষ্ঠানটিতে আমি গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম বাংলা একাডেমিতে। সেই একবারই বাবা দায়িত্বে থাকতে গান করতে পেরেছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে কেন তিনি অনুষ্ঠানটি করতে দিলেন। তখন তিনি ঘটনাটি আমাকে বললেন। আগে বলেননি, যদি আমি ভয়ে গান করতে না পারি!

LEAVE A REPLY