ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত সব রাজনৈতিক দল একমত হলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনে আপত্তি নেই সরকারের। এ বিষয়ে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছে। অপরদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক হবে।
সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদষ্টো অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে পৃথক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের কাছে এসব তথ্য জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও প্রধান উপদষ্টোর প্রেস সচিব শফিকুল আলম। বৈঠকে প্রয়োজনীয় সংস্কারে বিএনপি সমর্থন জানিয়ে বলেছে, সরকারের প্রতি তাদের সহযোগিতাও অব্যাহত থাকবে। এছাড়া বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা পুনর্বযক্ত করা হয়।
এর আগে সন্ধ্যা ৬টার দিকে প্রধান উপদষ্টোর সঙ্গে বিএনপির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল যমুনায় বৈঠকে বসে। বিএনপির পক্ষে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বৈঠকে ছিলেন। এ সময় আইন উপদষ্টো আসিফ নজরুল, অর্থ উপদষ্টো ড. সালেহউদ্দিন এবং শিল্প উপদষ্টো আদিলুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় এ বৈঠক চলে।
বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদষ্টো আশ্বস্ত করেছেন অতিদ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করছেন।’ আমরা আশা করব, অতি দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবে সরকার। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি, জনগণও প্রত্যাশা করছে।’
অপরদিকে পৃথক ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদষ্টোর প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, যদি সব রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়, সেক্ষেত্রে তিনি (প্রধান উপদষ্টো) তো বলেছেন, এমন নয় যে উনি একটি স্থির জায়গায় আছেন। রাজনৈতিক দলগুলো কী সংস্কার চায়, এর ওপর নির্ভর করবে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধান উপদষ্টোকে চার পৃষ্ঠার একটি চিঠি দেওয়া হয়। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ, প্রশাসনের সর্বস্তর পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরমুক্ত করা, নতুন দল গঠন ইসু্যসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি বিএনপির সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলেও চিঠিতে উলে্লখ করা হয়।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমরা আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে কোনোভাবেই একমত হব না। আগে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। এর আগে কোনো নির্বাচন হবে না। এটা আগেও পরিষ্কার করে বলেছি।’
কবে নাগাদ রোডম্যাপ ঘোষণা দেবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা ওনারা (সরকার) দেবেন। ১৫ তারিখের মধ্যেই ওনারা কিছু একটা বলতে পারেন।
বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘প্রধান উপদষ্টোর সঙ্গে বৈঠক করে যেগুলো উদ্বেগের বিষয়, সেগুলো তুলে ধরেছি। বৃহত্তর দল হিসাবে আমাদের একটা দায়িত্ব ছিল, সেটি পালন করেছি। সম্প্রতি যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, এগুলোর দায় সরকার এড়াতে পারে না। কারণ, রাষ্ট্রীয় যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, বাহিনীগুলো, তাদের সামনে ঘটনা ঘটেছে। এতে সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি বা স্থিতিশীলতা ব্যাপকভাবে বিপন্ন করেছে। এসব কারণে ফ্যাসিবাদকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত নির্বাচন করার জন্য তাগাদা দিয়েছি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ন্যূনতম আলোচনার পর দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছি। প্রশাসনে যারা ফ্যাসিবাদের দোসর, যারা বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে এবং পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছি। সেই সঙ্গে যারা দেশের অর্থনীতি লুণ্ঠন করেছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনাসহ শাসি্তর দাবি করেছি। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার কথাও বলেছি।’
তিনি বলেন, ১৫-১৬ বছর ধরে আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহারের জন্য দাবি করেছি। নৈতিকভাবে তারাও এ বিষয়ে একমত হয়েছেন। আমরা বলেছি, সরকারের প্রধান ব্যর্থতা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। এ ব্যাপারে সরকার আমাদের বলেছে, তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন।
বিশেষ অভিযান ‘ডেভিল হান্ট’ সম্পর্কে মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান উপদষ্টোকে বলেছি এ ধরনের অভিযান আগে হয়েছিল। তবে কোনোভাবেই নিরপরাধ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হয়।
সংস্কারে বিএনপির পূর্ণ সমর্থন প্রেস সচিব : বৈঠক শেষে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে সংস্কার কার্যক্রমে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মূলত বিএনপির নেতারা দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শানি্ত ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় জোর দিয়েছেন। এছাড়াও ১৫ বছরে যারা দেশের মানুষের ওপর অন্যায় ও অত্যাচার করেছে, তাদের বিচারকাজ যাতে খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়, সে ব্যাপারে বিএনপির নেতারা কথা বলেছেন।
শফিকুল আলম বলেন, বিগত সময়ে বিএনপি এবং বিরোধীমতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ২৫ হাজার মামলা দেওয়া হয়। এই মামলাগুলো হয়রানিমূলক। তাই এগুলো প্রত্যাহার করার কথা বলেছেন। অপারেশন ডেভিল হান্টে যেন কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়, সে ব্যাপারে কথা বলেছে বিএনপি। এক্ষেত্রে প্রধান উপদষ্টোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনোভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে দেওয়া হবে না। যাদের ব্যাপারে সুনির্দষ্টি অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধেই ডেভিল হান্টে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। বিষয়টি সরকার সিরিয়াসলি নজরদারি করছে। শফিকুল আলম বলেন, বৈঠকে উপদষ্টো আসিফ নজরুল বলেছেন, হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহারের ব্যাপারে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। এগুলো এতদিন বিলম্ব হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, ওই সময়ে যারা পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন, তাদের অনেকে পালিয়েছেন। ফলে মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহার করা যায়নি।
বইমেলায় ভাঙচুরের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি জেনেছি। এ নিয়ে বাংলা একাডেমির সঙ্গে কথা হয়েছে। বিষয়টি তাদেরকে দ্রুত জানাতে বলা হয়েছে। এখনো আমরা পুরোর বিষয়টি জানি না। আমরা মনে করি, বইমেলা পবিত্র জায়গা এবং এর পবিত্রতা আমরা রাখতে চাই।’
প্রধান উপদষ্টোকে বিএনপির চিঠি : সূত্রমতে, বৈঠকে বিরাজমান রাষ্ট্র পরিস্থিতি বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে প্রধান উপদষ্টোকে লিখিত চিঠি দিয়েছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চার পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘পতিত ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করে যাচ্ছে এবং প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের সহায়তায় দেশের বাইরে থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এই তত্পরতা চালিয়েই যাবে। সুতরাং গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা দরকার। বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার ৬ মাসেও পলাতক স্বৈরাচার এবং তাদের দোসরদের আইনের আওতায় আনতে যথষ্টে কার্যকর পদক্ষেপ জনসম্মুখে দৃশ্যমান করতে সফল হয়নি বলে জনমনে প্রতিভাত হয়েছে। ফলে জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো বেআইনি কর্মকাণ্ডে উত্সাহিত হচ্ছে। একটি সরকার বহাল থাকা অবস্থায় জনগণ এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নিলে দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। অথচ জুলাই ছাত্র গণ-অভু্যত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী জনগণের প্রত্যাশা ছিল দেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, যা বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল।’
আরও বলা হয়, ‘বিরাজমান অস্থিতিশীল রাষ্ট্র পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিনিয়োগ-বাণিজ্যে স্থবিরতা ও বাজার সরবরাহব্যবস্থায় নৈরাজ্যপনা ইত্যাদি সীমাহীন জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের দাবিনামা নিয়ে মব কালচারের মাধ্যমে সীমাহীন জনদুর্ভোগ, সড়কে উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষণীয়, যা সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে মুনশিয়ানা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে। একধরনের সামাজিক নৈরাজ্যের বিস্তার লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে গণ-অভু্যত্থানের জন-আকাঙ্খা ম্রিয়মাণ হতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতির উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের সার্বিক আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং সার্বিক গণতানি্ত্রক, সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিতকরণ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে জন-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।’
নির্বাচনমুখী জরুরি সংস্কার সাধন করে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করাই বর্তমান সরকারের প্রধানতম ম্যান্ডেট উলে্লখ করে বলা হয়, ‘জুলাই ছাত্র গণ-অভু্যত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে মানুষের হারানো গণতানি্ত্রক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকারসহ ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাশীঘ্র সম্ভব একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
চিঠিতে বলা হয়, ‘বিদ্যমান ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য এই দেশ এবং দেশের মানুষের মূল চালিকাশক্তি, এই ঐক্যকে বজায় রেখে এ দেশকে এগিয়ে নিতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
নতুন দল গঠন ইসু্যতে বলা হয়, অন্তর্র্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদষ্টো ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত রয়েছেন মর্মে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করার নানা প্রকার লক্ষণ ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে, যা দেশ ও গণতনে্ত্রর জন্য মোটেই সুখকর নয়। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী যথাযথ গণতানি্ত্রক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যে কোনো দলের আত্মপ্রকাশকে আমরা স্বাগত জানাব।