ছবিসূত্র : এএফপি
কিছুদিন আগে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার কুকুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করার আইন কার্যকর করেছিল। কিন্তু এখন, সেই নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের কুকুর মাংস শিল্পে এক নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যা অনেকের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকের মতো রেভারেন্ড জু ইয়ং-বংয়ের ব্যবসাও অস্বস্তিতে পড়েছে।
তিনি কুকুর পালন করছেন বিক্রি করার জন্য।
কিন্তু ব্যবসা ঠিকঠাক চলছে না। এমনকি, তিনি জানিয়েছেন, ‘গত গ্রীষ্ম থেকেই আমরা কুকুর বিক্রি করার চেষ্টা করছি, কিন্তু বিক্রেতারা কেবল মুচকি হাসি হাসছেন, একটাও কুকুর বিক্রি হয়নি।’
২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার কুকুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করার জন্য একটি আইন পাস করে। এই আইন অনুযায়ী, কুকুর মাংস উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীদের ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে।
তবে আইন প্রণয়নকারী কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, কুকুর মাংস শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কৃষকদের জন্য উপযুক্ত সহায়তার ব্যবস্থা করা এখনও কঠিন। বিশেষজ্ঞরা এবং পশু অধিকার সংগঠনগুলোও বলছেন, কুকুরদের পুনর্বাসন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক কুকুরের ভয়াবহ অবস্থা এবং তাদের কুকুর পালনের জন্য বৈধ অনুমতি নেই।
কুকুর ফার্মের মালিকদের দুর্দশা
জনাব চান-উ, ৩৩ বছর বয়সী এক কুকুর মাংস ফার্মের মালিক বলেন, ‘আমার কাছে ৬০০ কুকুর রয়েছে, যেগুলো আমি ১৮ মাসের মধ্যে বিক্রি করতে পারব না।
আমি আমার সম্পদ এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি, কিন্তু তারা কুকুরও কিনছে না।’
তিনি আরো জানান, ‘যারা এই শিল্প নিষিদ্ধ করার পক্ষে ছিলেন, তারা এখনো কোনো সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেননি, যা কুকুরদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা হতে পারে। প্রায় ৫ লাখ কুকুর সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে।’
পশু অধিকার গ্রুপদের তীব্র বিরোধিতা
প্রাণী অধিকার গোষ্ঠী ‘হিউম্যান ওয়ার্ল্ড ফর অ্যানিম্যালস’ জানিয়েছে, কুকুরগুলোকে উদ্ধার করে তাদের পুনর্বাসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ কুকুর মাংস উৎপাদনকারী ফার্মগুলো সাধারণত বড় ধরনের কুকুর পছন্দ করে, যা শহরাঞ্চলে বাস করা মানুষদের কাছে পোষ্য হিসেবে নেওয়া সহজ নয়।
এ ছাড়া কুকুরে মাংস খাওয়ার প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে অনেকেরই মানসিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। পশু অধিকার কর্মীরা জানান, মাংস খাওয়ার জন্য চাষ করা কুকুরগুলো কিছু ক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থায় থাকে, যার ফলে তাদের পুনর্বাসন আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সরকারের নতুন পদক্ষেপ এবং প্রতিক্রিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা বছরে ৬০০ কোটি কোরিয়ান ওয়ান (৪.৩ মিলিয়ন ডলার) পরিমাণ তহবিল বরাদ্দ করবে, যা পশু পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং প্রাইভেট শেল্টারগুলোর সহায়তার জন্য ব্যবহৃত হবে। তারা আরো বলেছে, যদি কৃষকরা তাদের ফার্ম বন্ধ করেন, তাদের ৬০ হাজার কোরিয়ান ওয়ান (৪৫০ ডলার) পর্যন্ত সহায়তা দেওয়া হবে।
তবে, পশু অধিকার গোষ্ঠী দাবি করেছে, এই পদক্ষেপে কোনও সুস্পষ্ট উদ্ধার ব্যবস্থা নেই। তাদের মতে, তারা দীর্ঘ সময় ধরে কুকুর মাংস ফার্ম থেকে ২ হাজার ৮০০টি কুকুর পুনর্বাসন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ কুকুর পুনর্বাসন করার জন্য তাদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে তারা যথেষ্ট নয়। এই অবস্থা যেমন অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে কুকুর মাংস ব্যবসায়ীদের, তেমনি তাদের পরিবারগুলোর জন্যও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। অনেকেই একে একে ব্যবসা বন্ধ করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু কুকুরগুলো বিক্রি না হওয়া এবং সরকারের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠতে না পারার কারণে তারা হতাশায় ভুগছেন।
রেভারেন্ড জু ইয়ং-বং বলেন, ‘আমরা এখন দেনার মধ্যে ডুবে গেছি। এটি একেবারে হতাশাজনক পরিস্থিতি।’ এদিকে অনেক পশু পালনকারী আরো আশঙ্কা করছেন, কুকুর মাংস শিল্পের পরিসমাপ্তি দ্রুত ঘটলে, তারা নতুন কাজ খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়তে পারেন।
একটি নতুন প্রতিক্রিয়ার সঙ্গেও তারা আশায় বুক বাঁধছেন যে, হয়তো সরকারের সহায়তা এবং সময়সীমা বাড়ানো হবে, যাতে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে সমাধান করা যায়। এখনও বেশ কিছু কুকুরকে পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান এবং সহায়তা পাওয়া যায়নি এবং অনেকেই আশঙ্কা করছেন, তাদের জীবনের স্বপ্ন ভেঙে যাবে। ২০২৭ সালে নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি কার্যকর হলে, এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লাখ লাখ কুকুরের ভবিষ্যত কী হবে তা এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
সূত্র : বিবিসি