দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আজ। রাত ৮টায় বঙ্গভবনে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৫ উপদেষ্টা শপথ নেবেন। এ উপলক্ষ্যে ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। বঙ্গভবনের দরবার হলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৪শ মানুষ উপস্থিত থাকবেন। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এসব বিষয়ে নিশ্চিত করেন। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা, অন্য উপদেষ্টাদের নাম এবং সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে, তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
এদিকে দেশের অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নিতে রাজি হওয়ায় ড. ইউনূসকে স্বাগত জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী নেতা, বিদেশি দূতাবাস, পেশাজীবী এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা।
জানা গেছে, সরকারের প্রধান হিসাবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মনোনীত করা হয়েছে। তার নেতৃত্বে গঠিত হতে যাচ্ছে নতুন এই সরকার। এ সরকারের বাকি সদস্যদের নাম ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এই সরকার দায়িত্ব পালন করবে। ড. ইউনূস আজ দুপুর ২টা ১০ মিনিটে ফ্রান্স থেকে দেশে আসবেন। এদিকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় শ্রম আদালতের দেওয়া কারাদণ্ড থেকে বুধবার খালাস পেয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল বুধবার ওই রায়ের বিরুদ্ধে ড. ইউনূসসহ অন্যদের করা আবেদনের শুনানি শেষে এ রায় দিয়েছেন। ড. ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ফলে সরকারপ্রধান হিসাবে শপথ নিতে তার কোনো আইনগত বাধা নেই।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত রোববার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। পদত্যাগের পর তিনি ও তার বোন শেখ রেহানা প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অন্য মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হয়। অর্থাৎ রোববারই মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হয়েছে। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ১১ জানুয়ারি সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ। ওইদিনই (রোববার) আওয়ামী লীগ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে মঙ্গলবার সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে মঙ্গলবার তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ জন সমন্বয়কের চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দীনও উপস্থিত ছিলেন। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাকি সদস্যদের নাম চূড়ান্ত করা হয়।
বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে সেনাপ্রধান বলেন, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস ২টা ১০ মিনিটে দেশে আসবেন। ‘আমিসহ তিন বাহিনীর প্রধান ওনাকে রিসিভ করার জন্য এয়ারপোর্টে যাব। শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান বিকালে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটি ওনার (ড. ইউনূস) জন্য টাইট হয়ে যায়। তাই রাত ৮টায় করার চেষ্টা করব।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হবে ১৫ জন। হয়তো আরও দু-একজন বাড়তে পারে। এ সময় নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের প্রেস সেক্রেটারি মো. জয়নাল আবেদীন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দিক থেকে সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধান মো. সাহাবুদ্দিন এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ সমস্যার সমাধানে যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে সমস্যার সমাধান দরকার। তিনি এ সংকটকালীন সমস্যার সমাধানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্য উপদেষ্টাদের নাম চূড়ান্ত করা হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি এ সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন। তবে বুধবার বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি।
কোটা সংস্কার দাবিতে গত ১ জুলাই শুরু হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। ওই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুহুর্মহু গুলি, গণগ্রেফতার এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলা ও সংঘর্ষ একপর্যায়ে সরকার পতনের একদফা দাবিতে রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার কারফিউ ভেঙে গণভবন অভিমুখো লাখো মানুষের ঢল নামলে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর মঙ্গলবার দুপুরে বঙ্গভবন থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এতে আরও জানানো হয়, তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। গত জানুয়ারিতে শুরু হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ মাত্র ৬ মাসের মাথায় ভেঙে দেওয়া হলো। সংসদ ভেঙে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন শেখ হাসিনা। একই বছরের ৩০ জানুয়ারি সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। ওই হিসাবে সরকার গঠনের মাত্র ছয় মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। আর সংসদ গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় তা ভেঙে দেওয়া হলো। এর আগে সোমবার শেষ রাতের দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই প্রস্তাবে সম্মতি দেন তিনি। এ বিষয়ে ড. ইউনূস গতকাল বলেছেন, যে ছাত্ররা এত ত্যাগ স্বীকার করেছে, এই কঠিন সময়ে তারা যখন আমাকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেছে, আমি কীভাবে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারি। এদিকে ড. ইউনূসকে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতাসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে তারা স্বাগত জানান।