সংগৃহীত ছবি
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ বাতিলের জোরালো দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ১০০ নাগরিক। তাঁরা বলেছেন, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের বেশ কিছু ধারা মানবাধিকারসংশ্লিষ্ট কনভেনশনের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এই অধ্যাদেশ জুলাই আন্দোলনের মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও তরুণদের নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নবিরোধী। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করার পর বাক্স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এমন বেপরোয়া কর্তৃত্ববাদী আইন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
রবিবার (১৯ জানুয়ারি) গণমাধ্যমে বিবৃতিটি পাঠানো হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে। তবে এই অধ্যাদেশ জারির আগে পর্যালোচনার দাবি উঠেছে।
১০০ নাগরিকের বিবৃতিতে বলা হয়, বহুল ব্যবহৃত এবং বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বাতিল করা ছিল এই গণ-অভ্যুত্থানের সরকারের একটি অত্যাবশ্যক ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
আগের আইনটি অপপ্রয়োগ করে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশে বাক্স্বাধীনতা কার্যত স্তব্ধ করে ভীতি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শাসন কায়েম করতে সফল হয়েছিল। ওই আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহার ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আশা ছিল, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই অপআইন সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে তার পরিবর্তে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা এবং নাগরিক অধিকারভিত্তিক একটি জনমুখী, সুচিন্তিত, সুসংগত ও সুশাসনমূলক আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু এই আইন পরিমার্জন করে যে অধ্যাদেশ জারি করা হচ্ছে, জনগণের মৌলিক মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ চরমভাবে অগ্রাহ্য, ক্ষেত্রবিশেষে খর্ব ও নিতান্ত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
এই অধ্যাদেশের অন্যতম আপত্তিকর ধারা ৩৫ এবং ৩৬, যেগুলি ব্যবহার করে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় যে কারো ফোন ল্যাপটপ বা যে কোনো ডিভাইস জব্দ ও তল্লাশি করতে পারে এবং ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তার ‘বিশ্বাস করার কারণ থাকলে’-ই তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের অনুমতি তাদের দেওয়া হয়েছে এই দুই ধারায়।
যে বাংলাদেশের পুলিশের দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সর্বজনবিদিত, যেখানে জুলাইয়ের পর পুলিশের জবাবদিহিতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত ছিল, তা না করে পুলিশের হাতে জন হয়রানির একটি নতুন হাতিয়ার তুলে দেওয়া হচ্ছে। পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি এবং গ্রেপ্তার কোনো স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কাম্য হতে পারে না। এটি সরাসরি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার লঙ্ঘন এবং মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ধারা ৮-এ বলা হয়েছে যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যদি মনে করে কোনো তথ্য বা উপাত্ত দেশের সংহতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধ ক্ষুণ্ণ করতে পারে তাহলে তারা মহাপরিচালকের অনুমতি সাপেক্ষে এই তথ্য প্রচার ব্লক করে দিতে পারে। সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এই ধারা অপব্যবহারের পথ খুলে দেওয়া হচ্ছে। যদি কোনো ব্যক্তি বা সংবাদ মাধ্যম সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুষ্কর্ম তুলে ধরার সাহস করে তাহলে তাকে অনায়াসে এই আইনের আওতায় নিয়ে আসা যাবে।
অধ্যাদেশ অনুসারে, রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্রের চাকরিরত কর্মকর্তারা দেশের সংহতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদির সংজ্ঞা নির্ধারণ করবেন এবং তা লঙ্ঘন হয়েছে কি না সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করার পর বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে এমন বেপরোয়া কর্তৃত্ববাদী আইন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
ধারা ২৫ এবং ২৬-এ ব্যক্তিগত হয়রানি, অপমান, ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বলা হয়েছে যা অত্যন্ত আপেক্ষিক একটি বিষয়। এই ধারার আওতায় কাউকে হয়রানির উদ্দেশ্যে খুব সহজেই কারো বিরুদ্ধে মামলা করা সম্ভব।
ক্ষমতাসীন সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে কার্টুন এবং প্যারোডির ব্যবহার হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। কিন্তু গত ১৫ বছরে সরকারকে সমালোচনা করে কোনো কার্টুন প্রকাশ করা হলে তার সঙ্গে জড়িতদের দুর্বিষহ অত্যাচার করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় মিম, দেয়ালচিত্র এবং কার্টুন ছিল আমাদের অন্যতম শৈল্পিক হাতিয়ার। অথচ ধারা ২৫-এ আরো বলা হয়েছে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন বা অপমান করার উদ্দেশ্যে তৈরী স্থির চিত্র, ভিডিও, গ্রাফিক্স ইত্যাদি যার কোনো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই, এমন উপাত্ত প্রকাশ বা প্রচার আইনত দণ্ডনীয়। কিন্তু এখানে শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য বলতে কি বুঝানো হচ্ছে তা বলা হয়নি। অপমান বা হেয় করার ব্যাপারটিও সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এর মাধ্যমে শুধু শিল্পীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না, সৃজনশীলতার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। একটি চিত্রের শৈল্পিক মূল্য আছে কি নেই তা পুলিশ নির্ধারণ করতে পারে না।
নতুন উপধারায় নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট বা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপনের কথা বলা হয়েছে কিন্তু কতদিনের মাঝে তা উল্লেখ নেই। পুলিশ বা অন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো জবাবদিহিতা থাকছে না।
সর্বোপরি, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতির সংস্থার বিভিন্ন মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। এই আইনের বেশ কিছু ধারা সেগুলোর সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
উপরোক্ত উল্লেখিত এসব ধারা এবং অনুরূপ আরো অনেক কারণে কোনো সচেতন নাগরিক এই অধ্যাদেশ মেনে নিতে পারে না। ছাত্র-জনতার রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত দায় ও দরদের এই সরকারের অমোঘ দায়িত্ব আগের ফ্যাসিস্টদের কলঙ্কময় কার্যকলাপ পেছনে ফেলে জাতির জন্য নতুন দিন নিয়ে আসা। কিন্তু সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ নাম নতুন মোড়কে পুরোনো কালাকানুন এর অবতার মাত্র। এটা জুলাই আন্দোলনের মূল্যবোধ সাংঘর্ষিক ও তরুণের নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বিরোধী।