শিশুশ্রমমুক্ত বিশ্ব গড়ার লক্ষ্য ব্যর্থ

ফাইল ছবি : এএফপি

২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত বিশ্ব গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলেও এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ব। ২০২৪ সাল পর্যন্ত সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৩ কোটি ৮ লাখ শিশুকে জীবনধারণের জন্য বিভিন্ন কাজ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৪০ লাখ শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কর্মরত। 

আন্তর্জাতিক শিশুশ্রমবিরোধী দিবস উপলক্ষ্যে প্রকাশিত এক যৌথ প্রতিবেদনে গত বৃহস্পতিবার এই তথ্য জানায় জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও।

সংস্থাটির ধারণা, শিশুশ্রমমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে আরো কয়েক দশক লাগতে পারে। তবে এই সময়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে। ২০০০ সালে বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৪ কোটি ৫৫ লাখ। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ১৬ কোটিতে নেমে আসে।

এরপর ২০২৪ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ কোটি আট লাখে।

ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেমন খনিজ সম্পদ উত্তোলন, কলকারখানা ও কৃষিখাতে কর্মরত শিশুদের সংখ্যাও কমে এসেছে। এই সংখ্যা ২০০০ সালে ছিল সাত কোটি ৯০ লাখ, যা ২০২৫ সালে নেমে এসেছে পাঁচ কোটি ৪০ লাখে।

আফ্রিকার পরিস্থিতি ভিন্ন
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুশ্রম কমে আসলেও সাব-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলোতে এখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের শিশুশ্রমিকের আট কোটি ৭০ লাখই সাব-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলোতে।

ইউনেসেফের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক আঞ্চলিক উপদেষ্টা নানকালি মাকসুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ব্যাপ্তির দিক থেকে এটি কমে এসেছে। ২০০০ সালে ২৪ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে তা ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। এই অঞ্চলে যেই জটিলতাটি হচ্ছে তা হলো, দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধি। আর তাই সংখ্যার বিচারে আমাদের আসলে ততটা উন্নতি হয়নি।’

মাকসুদ জানান, বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয় হলো, পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কাজে নিয়োজিত। তার মতে, গ্রামাঞ্চলে মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণে যথেষ্ট কাজ হচ্ছে না। তাদেরকে দরিদ্রতা থেকে টেনে তোলার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং অর্থায়ন করা না গেলে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবে না। সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করার মাধ্যমে মা-বাবাকে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে সচেতন করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি। তা ছাড়া শিশুশ্রম বন্ধে শক্তিশালী আইনের ব্যবহারের প্রয়োজন বলে জানান মাকসুদ।

তিনি আরো বলেন, ‘বেশির ভাগ দেশেই এই বিষয়ে আইন রয়েছে। তবে আইনের ব্যবহার খুব দুর্বল।’

মাদাগাস্কারে ইউনিসেফের প্রধান লিসা সিমারমান বলেন, ‘পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ৪৭ ভাগই শিশুশ্রমের কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছে।’ ডয়চে ভেলেকে তিনি আরো বলেন, ‘মাদাগাস্কারের শিশুদের ৩২ ভাগ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে।’

ইউনিসেফের এই কর্মকর্তা বলেন, মেয়েদের চেয়ে ছেলে শিশুরা কিছুটা বেশি ক্ষতির শিকার। তা ছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামের শিশুরা এই পরিস্থিতির বেশি শিকার হয়।’

জলবায়ু পরিবর্তন ও শিশুশ্রম
আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারের কথাই ধরা যাক। খরা, সাইক্লোনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্লিষ্ট কৃষি নির্ভর এই দেশটি। ডয়চে ভেলেকে সিমারমান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে পরিবার ও শিশুরা বিভিন্ন রকমের ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত হয়। অন্যদিকে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের কিছু মানুষ কৃষিকাজের পাশাপাশি মিকা নামের খনিজ উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত। 

উল্লেখ্য, মাদাগাস্কার হলো রাশিয়া ও ভারতের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মিকা রপ্তানিকারক দেশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরিতে এই খনিজ ব্যবহার হওয়ায় দেশটিতে মিকা উত্তোলন বাড়ছে।

সিমারমান বলেন, পরিবারের খাবার যোগাতে সাধারণত শিশুরাই এধরনের খনিতে কাজে যেতে বাধ্য হয়। মিকা উত্তোলনে প্রায়ই পুরো পরিবার যুক্ত হয়ে পড়ে। এই কর্মীরা জাতিসংঘের গবেষকদের জানান, পরিবারের সদস্যরা মিকা উত্তোলনে না গেলে খাবার যোগান ব্যহত হয়।

শিশুশ্রম চলছেই
আইএলওর মতে, শিশুশ্রম ওই ধরনের কাজ, যা শিশুকে তাদের শৈশব, মর্যাদা, সম্ভাবনা ও উন্নয়ন, বিশেষ করে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে। তবে শিশুশ্রম কী—এ বিষয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তাদের নিজস্ব বোঝাপড়া রয়েছে। 

আফ্রিকার দেশ ঘানার সমাজে বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লিন্ডা ওসেই। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না, কোনো মাবাবা তাদের আট বছরের শিশুকে শারিরীকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ার জন্য খনিতে পাঠাতে চাইবে। কিন্তু যেহেতু এটি এখানকার ঐতিহ্য, শিশুরা পরিবারের ভরণপোষণ উপার্জনে সহায়তা করে, আর তাই মা-বাবারা তাদের সন্তানদের ছোট আকারের, গতানুগতিক পদ্ধতির খনিতে নিয়ে যায়।’

অবশ্য চাকরিদাতারা খনিতে মা-বাবার সঙ্গে শিশুদের কাজে যোগদানের অনুমতি দেয়। ছোট শিশুদের সাধারণত বিভিন্ন জিনিস গোছানো, কোনো কিছুর ওপরে বেয়ে উঠে কাজ করা যেখানে প্রাপ্ত বয়স্করা যেতে পারেনা, এমন সব কাজে যোগদানের অনুমতি দিয়ে থাকে।

প্রয়োজন সঠিক পথ
২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধ করতে না পারলেও বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করেন মাকসুদ। তার মতে, শিশুশ্রম বন্ধে আইনি কাঠামো চালু করা একটি বড় পদক্ষেপ। সেই সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার সুযোগ, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা লাভের সুযোগ বাড়ানোকে কার্যকর পদ্ধতি বলে মনে করেন তিনি।

মাকসুদ বলেন, ‘আমরা যদি তাদেরকে (পরিবারগুলোকে) পথ দেখাতে পারি, সম্ভবত তারা তাদের সন্তানদেরকে কাজে যেতে বলবে না।’

LEAVE A REPLY