সংগৃহীত ছবি
নতুন নতুন আন্তনগর ট্রেন চালুর পেছনে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং রাজনৈতিক চাপ দীর্ঘদিন ধরেই রেলওয়ের জন্য বিরাট এক বোঝায় পরিণত হয়েছে। যাত্রী চাহিদার প্রকৃত চিত্র বিবেচনায় না নিয়ে এসব ট্রেন চালু করার ফলে বর্তমানে অধিকাংশ রুটেই লোকসান গুনছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এমনকি কিছু ট্রেন এতটাই কম যাত্রী বহন করছে যে, খরচের ন্যূনতম অংশও উঠে আসছে না।
এমনই একটি ট্রেন বিজয় এক্সপ্রেস।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম রুটে চালু হওয়া বিজয় এক্সপ্রেস এখন জামালপুর থেকে চলাচল করছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই পরিবর্তন আনা হয়, যদিও এর পেছনে কোনো অর্থনৈতিক সমীক্ষা ছিল না। রেল কর্মকর্তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের একাধিক নেতার আবদারেই নেওয়া হয়, যার ফলে যাত্রীর সংখ্যা কমে গিয়ে ট্রেনটি এখন লোকসানি রুটে পরিণত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অসংখ্য নতুন ট্রেন চালু হয়েছে, যার বেশিরভাগই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চাপে।
বিশেষ করে সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন তার নিজ জেলা পঞ্চগড়কে ঘিরে বেশ কয়েকটি আন্তনগর ট্রেনের গন্তব্য বাড়ান এবং একটি নতুন স্টেশনের নামকরণও করেন পরিবারের সদস্যের নামে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বর্তমানে অন্তত পাঁচটি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করছে যেগুলোতে যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। এসব ট্রেন রাজনৈতিক চাপে চালু করা হলেও সেগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নিলে স্থানীয় বাধার মুখে পড়ে রেল কর্তৃপক্ষ।
২০১৮ সালে ঈশ্বরদী থেকে পাবনার ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা।
কিন্তু কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া এই প্রকল্প নেওয়া হয়। উদ্বোধনের পর দুই বছর কোনো ট্রেন চালানো হয়নি। পরে ২০২০ সালে একটি মাত্র ট্রেন চালু হয়, যার যাত্রীসংখ্যা ও রাজস্ব আশানুরূপ নয়।
সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের চাপে ২০১৩ সালে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস চালু করা হয় সিরাজগঞ্জ শহর থেকে। কিন্তু এই ট্রেন রাখার জায়গা না থাকায় প্রতিদিন ঈশ্বরদীতে নিয়ে গিয়ে রাখা হয় এবং আবার সিরাজগঞ্জে এনে যাত্রী ওঠানো হয়, ফলে সময় ও জ্বালানি অপচয় হয়।
যদিও ট্রেনটি গড়ে ৮৮% আসন পূর্ণ করে, মাসিক আয় মাত্র ৩০ লাখ টাকা।
একসময় ঢাকা-নোয়াখালী রুটে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনে যাত্রী হতো দ্বিগুণেরও বেশি। এখন সেই সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। মূল কারণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেনে উন্নীত হওয়া এবং বাস সার্ভিসের মান উন্নয়ন। এর মধ্যেও ২০২৩ সালে আবার একটি নতুন ট্রেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয় — ‘সুবর্ণচর এক্সপ্রেস’, যার নাম ঠিক করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কোচ সংকটে ট্রেনটি চালু করা যায়নি।
তবে উত্তরাঞ্চলে যাত্রী বেশি হলেও এই অঞ্চলে ট্রেনের সংখ্যা কম। রেলের পশ্চিমাঞ্চল, অর্থাৎ রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগে যাত্রীচাহিদা অত্যন্ত বেশি। এই অঞ্চলের অধিকাংশ আন্তনগর ট্রেন গড়ে ১১৪ শতাংশ আসন পূর্ণ করে চলে। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, লালমনিরহাট এক্সপ্রেস ও একতা এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে যথাক্রমে দুই কোটি, সোয়া দুই কোটি ও চার কোটি টাকার বেশি মাসিক আয় হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত কোচ ও বিকল্প রেক না থাকায় এই ট্রেনগুলো নির্ধারিত সময় মেনে চলতে পারে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে রেলপথ রেশনালাইজেশনের পরিকল্পনা নেয়। এর লক্ষ্য হচ্ছে অলাভজনক ট্রেন বন্ধ করে লাভজনক রুটে নতুন ট্রেন চালু করা। অতিরিক্ত সচিব রূপম আনোয়ারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কার্যকর কোনো সুপারিশ আসেনি।
এসব বিষয়ে বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, রেলওয়ের প্রতিটি প্রকল্পের পেছনে একটি স্বচ্ছ সমীক্ষা থাকা জরুরি। কোন পথে কত যাত্রীচাহিদা, লাভ-লোকসান বের করা কঠিন কোনো কাজ নয়। সমীক্ষা ছাড়া নতুন ট্রেন চালু কিংবা নতুন স্টেশনে ট্রেন থামানো উচিত নয়। রেল কখনোই লাভের জন্য চলে না — এই কথা বলা এক ধরনের অপেশাদারিত্ব। বাস্তবতা হলো, রেল এখন এক টাকা আয় করতে আড়াই টাকা ব্যয় করছে — যা দেশের জন্য অর্থনৈতিক বোঝা।