বিষাক্ত মাশরুম খাইয়ে সাবেক স্বামীর বাবা, মা ও খালা শাশুড়িকে হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এক নারী। সোমবার (৭ জুলাই) দেশটির একটি আদালত ওই নারীকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়।
বহুল আলোচিত এ মামলাটি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আদালতে চলার পর অবশেষে রায় ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হলো। এ মামলা শুধু অস্ট্রেলিয়ায় নয় সারা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোর শিরোনাম হয়েছে। খবর আল জাজিরার।
দণ্ডপ্রাপ্ত নারীর নাম এরিন প্যাটারসন। হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন তিনি। এবং তার আইনজীবীরা এ ঘটনাকে ‘ভয়ানক দুর্ঘটনা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
কি হয়েছিল?
২০২৩ সালের ২৯ জুলাই ভিক্টোরিয়া রাজ্যের লিয়ংগ্যাথা শহরে নিজের বাসায় সাবেক শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে দুপুরের খাবারে আমন্ত্রণ জানান এরিন। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন তার শাশুড়ি গেইল প্যাটারসন, শ্বশুর ডোনাল্ড প্যাটারসন, গেইলের বোন হিদার উইলকিনসন ও হিদারের স্বামী ইয়ান উইলকিনসন। তবে প্রাক্তন স্বামী সিমন সাবেক স্ত্রীর এ নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেনি।
৫০ বছর বয়সি এরিন অতিথিদের জন্য বিফ ওয়েলিংটন পরিবেশন করেন। বিফ ওয়েলিংটন এমন একটি খাবার যেখানে গরুর মাংসের সঙ্গে মাশরুম পেস্ট ও পাফ পেস্ট্রি ব্যবহার করা হয়। সঙ্গে ছিল সিদ্ধ আলু ও শাকসবজি। অতিথিদের দেওয়া সেই খাবার এরিন নিজেও খেয়েছিলেন।
খাবার গ্রহণের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে চার অতিথি। পরবর্তীতে দ্রুত তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গেইল, ডোনাল্ড ও হিদার মারা যান। কোনোভাবে বেঁচে যান হিদারের স্বামী ইয়ান। তবে, এর আগে হাসপাতালে কয়েক সপ্তাহ কোমার মধ্যে ছিলেন তিনি। মৃত্যুর সময় গেইল ও ডোনাল্ডের বয়স ছিল যথাক্রমে ৭০ বছর করে। আর হিদারের বয়স ছিল ৬৬ বছর।
এরিনের আইনজীবী বলেন, খাবার খেয়ে তার মক্কেলও অসুস্থ হয়ে পড়েন। আদালতে মেডিকেলের কাগজপত্রও জমা দেন তিনি। পরে জানা যায়, বিফ ওয়েলিংটনদের মধ্যে বিষাক্ত ডেথ ক্যাপ মাশরুমের মিশ্রণ ছিল।
আইনজীবীরা জানান, এরিন ও সিমনের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়েছিল। বিচ্ছেদের পরও তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। সিমন ও এরিন দম্পতির দুই সন্তান রয়েছে। দুপুরের খাবারের সময় তারাও সেখানে ছিল। কিন্তু তারা বিফ ওয়েলিংটন খায়নি।
২০২৩ সালের নভেম্বরে এরিনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর থেকে কারাগারে রয়েছেন তিনি। গেইল, ডোনাল্ড ও হিদারকে হত্যায় অভিযুক্ত হয়েছেন এ নারী। এমনকি, হিদারের স্বামী ইয়ানকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগেও অভিযুক্ত হয়েছেন তিনি। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এরিনের বিচারকার্যের জন্য বিচারকদের একটি টিম গঠন করা হয়। এ রায় দেওয়ার সপ্তাহখানেক আগে থেকে তাদের আলাদা রাখা হয়। এর মূলে ছিল বিচারকরা যেন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সোমবার সকালে তারা একত্রিত হয় এবং নিজেদের মতামত দেয়। এরপরই রায় প্রকাশ করা হয়।
ডেথ ক্যাপ মাশরুম কী?
অ্যামানিটা ফ্যালোয়েডস বা ডেথ ক্যাপ একটি বিষাক্ত মাশরুম যা পার্ক এবং বাগানের ওক গাছের নিচে জন্মে। মাশরুমের এ জাতটি মানুষের জন্য বিষাক্ত। প্রতি বছর বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশের মৃত্যুর জন্য দায়ী এ ডেথ ক্যাপ মাশরুম।
মাশরুমটি টক্সিন ডিএনএ তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে লিভার ও কিডনি বিকল হয় এবং মৃত্যু ঘটে। রান্না করলেও এর বিষ দূর হয় না। মাত্র একটি মাশরুমই একজন প্রাপ্তবয়স্ককে মারতে যথেষ্ট।
এ জাতের মাশরুম খাওয়ার ছয় থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে মানুষের ব্যাথা শুরু হয়। পাশাপাশি বমি ও ডাইরিয়া হয়। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় এ মাশরুম পাওয়া যায়।
বিচার চলাকালে কী ঘটেছে?
২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল, ভিক্টোরিয়ার মোরওয়েল শহরের ল্যাট্রোব ভ্যালি ম্যাজিস্ট্রেটস কোর্টে মাশরুম মার্ডার কেসের বিচার শুরু হয়। বিচারক ক্রিস্টোফার বিয়েল মামলাটি পরিচালনা করছেন। এরিনের স্বজন ও বন্ধুদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
এরিনের বিপক্ষে এ মামলা লড়েছেন ন্যানেতে রজার্স। তিনি বলেন, বলেন, এরিন নিজেই বিষাক্ত মাশরুম সংগ্রহ করে ও খাবারে মিশিয়েছিলেন। তিনি পুলিশকে ভুল তথ্য দিয়েছেন যে তিনি কখনো মাশরুম তুলেননি। অথচ, তার বাড়ির কাছাকাছি একটি ময়লার ভাগাড়ে এমন ডেথ ক্যাপ মাশরুমের নমুনা ছিল। এছাড়া এরিনের ডেথ ক্যাপ মাশরুম নিয়ে ইন্টারনেটে খোঁজ নিয়েছেন।
নিজের সাক্ষ্যে হিদারের স্বামী ৭১ বছর বয়সি পাদ্রী ইয়ান জানান, ওই দিন এরিন কাউকে রান্নাঘরে যেতে দিতে চাচ্ছিলেন না। হিদার ও গেইল সহায়তা করতে চাইলেও তিনি নিজেই খাবার পরিবেশন করেন। ইয়ান বলেন, ‘রাতে আমি ও আমার স্ত্রীর বমি হয়। আমরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়।’
এরিনের আইনজীবী হিসেবে কাজ করা ব্যারিস্টার কলিন ম্যান্ডি বলেন, আমার মক্কেলের অতিথিদের খুন করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। যদিও তিনি স্বীকার করেন খাবারে ডেথ ক্যাপ মাশরুম ছিল। কলিন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এরিন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এর জেরে তিনি পুলিশকে ডেথ ক্যাপ মাশরুম নিয়ে কিছু বলেননি। খাবার খেয়ে এরিনও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি ও হিমোগ্লোবিন বেড়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যায়, যা ভুয়া হতে পারে না।’
আদালতকে এরিন বলেন, বিফ ওয়েলিংটনের অল্প একটি অংশ তিনি খেয়েছিলেন। সাবেক শাশুড়ি গেইল তার জন্য অরেঞ্জ কেক এনেছিলেন। অতিথিরা যাওয়োর পর সন্তানদের নিয়ে তিনি ওই কেক খান। এরিনের আইনজীবী কলিন বলেন, ‘২০২০ সালে কোভিড লকডাউনের সময় থেকে বাড়ির আশপাশ থেকে খাবার সংগ্রহ করা শুরু করেন এরিন। তার পক্ষে ডেথ ক্যাপ মাশরুম নিয়ে জানার বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়।’









































