দিল্লীর ঐতিহাসিক লাল কেল্লা মেট্রো স্টেশনের সামনে গত ১০ নভেম্বর ৬টা ৫২ মিনিটে একটি সাদা হুন্দাই গাড়ি আচমকা বিস্ফোরণে আগুনের গোলায় পরিণত হয়। মুহূর্তেই ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ১৩ জন। আহত হন অন্তত ২৩ জন। তবে কিছু কিছু গণমাধ্যমে নিহতদের সংখ্যা নয়জন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দিল্লি বিস্ফোরণে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরকসহ একটি গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। ভারতীয় ফরেনসিক সূত্র ধরে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, হুন্দাই আই-২০ মডেলের ওই গাড়িটিকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, জ্বালানি তেল এবং ডেটোনেটরের মিশ্রণে একটি নতুন প্রযুক্তির গাড়ি বোমায় রুপান্তর করা হয়েছিল। এটি ছিল উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক।
দেখতে একটি সাধাসিধে গাড়ি বলে মনে হলেও, এই গাড়িই যে এতো ভয়ংকর বোমা হয়ে উঠতে পারে সেটা ধারণায় ছিল না ভারতীয় আইনশৃংখলা বাহিনীর।দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এ ধরণের গাড়ি বোমা এর আগে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতেও ব্যবহৃত হয়েছে, যা এই উপমাহাদেশে নতুন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে এই গাড়িবোমার ধ্বংস ক্ষমতা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর কারখানায় বানানো বোমার মতোই। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফরেনসিক ল্যাবরেটরির পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন এখনও প্রস্তুত হয়নি। দিল্লি পুলিশ মঙ্গলবার এই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি এফআইআর (প্রথম তথ্য প্রতিবেদন) দায়ের করেছে, যা অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন এবং বিস্ফোরক আইন অনুযায়ী নথিভুক্ত করা হয়েছে।
এর আগে, ২০১১ সালের মুম্বাই বোমা হামলা এবং ২০১২ সালের পুনে বিস্ফোরণে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এ ধরণের গাড়িবোমা হামলা ভারতে প্রথমবার ঘটল। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘটনাটি ঘনবসতিপূর্ণ চাঁদনি চক এলাকার মধ্যে হওয়ায় আগুন ও ধোঁয়ায় ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, বিস্ফোরণের শব্দ ছিল বিকট। এটি একটি আত্মঘাতি হামলা ছিল।
তদন্তকারী সংস্থার তথ্যে জানা গেছে, নিহত সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ডা. উমর নবি ১০ নভেম্বর সকালে ওই গাড়িটি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিল্লির পথে রওনা দেন। উমর রিদাবাদের আল ফালাহ মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিটে, দিল্লির পুরনো এলাকার লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের ১ নম্বর গেটের কাছে ধীরগতিতে চলতে থাকা গাড়িটিতে হঠাৎ শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে।
মুহূর্তের মধ্যে আগুনে পুড়ে যায় গাড়িটি। আশপাশের যানবাহন ও পথচারীরাও আহত হন। ডা. উমর নবি ২৯ অক্টোবর ফরিদাবাদের সোনু নামের এক গাড়ি বিক্রেতার কাছ থেকে গাড়িটি কেনেন। একই দিন তিনি গাড়িটির দূষণ নিয়ন্ত্রণ (পিইউসি) সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য বাইরে যান।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ‘রয়্যাল কার জোন’ নামের অফিসের পাশের পিইউসি বুথে গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। পরে তিনি গাড়িটি নিয়ে আল-ফালাহ মেডিক্যাল কলেজে যান এবং সেখানে সহকর্মী ডা. মুজাম্মিল শাকিলের সুইফট ডিজায়ারের পাশে পার্ক করেন। তদন্তে জানা গেছে, এই শাকিলই সোমবার সকালে ‘বিস্ফোরক জব্দের’ ঘটনায় গ্রেপ্তার হন। তার গাড়ি নিবন্ধিত ছিল আরেক চিকিৎসক ডা. শাহিন সাঈদের নামে, যার গাড়ি থেকে পুলিশ একাধিক রাইফেল ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।
২৯ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ওই গাড়িটি কলেজ প্রাঙ্গণেই পার্ক করা ছিল বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। ১০ নভেম্বর সকালে সহযোদ্ধা ডা. মুজাম্মিল শাকিল ও ডা. আদিল আহমদ রাদার গ্রেপ্তারের খবরে নবি আতঙ্কিত হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এরপর গাড়িটিকে কনট প্লেস ও মায়ূর বিহার এলাকায় দেখা যায়। বিকেল ৩টা ১৯ মিনিটে চাঁদনি চক এলাকার সুনেহরি মসজিদের পার্কিংয়ে গাড়িটি প্রবেশ করে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ডা. নবি নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন এবং তিনি কোনো সময় গাড়ি থেকে নামেননি।
সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত গাড়িটি সেখানেই ছিল—এর পরেই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। ডা. মুজাম্মিল শাকিল ও ডা. আদিল আহমদ রাদারকে সোমবার সকালে জম্মু ও কাশ্মীর এবং হারিয়ানা পুলিশের যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় ২ হাজার ৯০০ কেজি বিস্ফোরক ও অস্ত্র। ধারণা করা হচ্ছে, এই ঘটনার পরই উমর নবি আতঙ্কিত হয়ে ‘ভুলক্রমে’ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেন।
লখনউয়ের নারী চিকিৎসক ডা. শাহিন সাঈদকেও মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করেছে দিল্লি পুলিশ। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেএম)-এর নারীবিভাগ গঠনে কাজ করছিলেন তিনি।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এটি আত্মঘাতী হামলা নয়, বরং বিস্ফোরক স্থানান্তর বা নিস্তেজ করার চেষ্টা চলাকালে দুর্ঘটনাবশত বিস্ফোরণ ঘটে। তদন্তকারীদের প্রাথমিক ধারণা, নবি যে বিস্ফোরক (আইইডি) তৈরি করেছিলেন তা সঠিকভাবে সংযোজন করা হয়নি—ফলে বিস্ফোরণের প্রভাব সীমিত ছিল।
দিল্লি বিস্ফোরণের একদিন পরেই পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের একটি আদালত ভবনের বাইরে ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত ও ২৭ জন আহত হয়েছেন। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, মঙ্গলবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে কাচেহরি (জেলা আদালত) এলাকায় এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরাও ভারতের এই ঘটনাকে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক ‘ওয়েক-আপ কল’ বলে মনে করছেন। তাদের মতে দিল্লির বিস্ফোরণের আগুন এখন নিভে গেছে, কিন্তু তার সঙ্গে ফুটে উঠেছে এক ভয়ঙ্কর সত্য। ভারতে এ ঘটনা পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় জন্য এখন জন্য আতঙ্ক।










































