‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র মানবিক সাহায্যবাহী নৌযানগুলোর বিশাল বহরের আটকে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে বিশ্ব। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকেই দেশে দেশে বিক্ষোভে নামেন হাজার হাজার মানুষ। বিশ্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পরদিনই বহরের শেষ নৌযানটিকেও আটক করে ইসরাইল। ৪৪ দেশের প্রায় ৫০০ অধিকারকর্মী নিয়ে ছুটে চলা ৪২ নৌকার বহরের শেষ নৌকাটিই ছিল ম্যারিনেট। শুক্রবার সকাল ১০টা ২৯ মিনিটে (স্থানীয় সময়) গাজা উপকূলের কাছে আসতেই ম্যারিনেটকে জিম্মি করে ফেলে ইসরাইলের নৌবাহিনী। জোর করে উঠে যায় ম্যারিনেটে (ভিডিও ফুটেজে দেখা)। আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় ইসরাইলের সর্বশেষ এই আগ্রাসী হানা দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে বিশ্ব মানবাধিকারকর্মীদের গাজার অবরোধ ভাঙার এক মাসেরও বেশি সময়ের নৌ-প্রচেষ্টা। তবু হাল ছাড়েনি ফ্লোটিলা। গাজা অভিমুখে নতুন করে আরও ১১টি নৌকার একটি ছোট বহর পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে ফ্লোটিলার আরেক অঙ্গসংগঠন ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি)। এই বহরেরই সবচেয়ে বড় জাহাজ কনসায়েন্সে রয়েছেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম। শিগগিরই বহরটি গাজার জলসীমায় প্রবেশ করবে বলেই নতুন আশায় বুক বেঁধেছে ফ্লোটিলা। এফএফসি, এএফপি, বিবিসি।
আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, গাজা থেকে ৪২.৫ নটিক্যাল মাইল (৮০ কিমি.) দূরে থাকতেই ইসরাইলের যুদ্ধজাহাজ থেকে নৌবাহিনীর একটি বোট ছুটে আসে। কাছে এসেই উঠে পড়ে ম্যারিনেটে। গাজা তখন মাত্র ৩৮ ঘণ্টার পথ! পোল্যান্ডের পতাকাবাহী ম্যারিনেটে ছয়জন আরোহী রয়েছেন।
শক্রবার সকালে জিএসএফ’র (গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা) বিবৃতিতে বলা হয়েছে , ‘গত ৩৮ ঘণ্টারও (বুধবার প্রথম হামলার সময় থেকে) বেশি সময় ধরে ইসরাইল আমাদের বহরের ৪২টি নৌকাকেই আটক করেছে। ম্যারিনেট ছিল শেষ নৌকা।’ জিএসএফ’র ওয়েবসাইট বলছে, অপহৃত মানবাধিকারকর্মীর সংখ্যা ৪৫৮ জন। কিন্তু ইসরাইলের পুলিশ বলছে, ৪৭০ জনেরও বেশি।
ফ্লোটিলার লাইভ ট্র্যাকার অনুযায়ী আন্তর্জাতিক জলসীমা ধরে গাজা অভিমুখে ছুটে চলা ম্যারিনেটের গতি ছিল তখন ঘণ্টায় প্রায় ২.১৬ নট (ঘণ্টায় প্রায় ৪ কিলোমিটার)। রাতেই গাজায় পৌঁছার সম্ভাবনা ছিল ম্যারিনেটের! টিমটিম করে জ্বলে থাকা ইসরাইলের অবরোধ ভাঙার আশার আলোটুকু নিভে গেলেও হার মানেনি ফ্লোটিলা। গাজা উপত্যকায় ফের নৌবহর পাঠিয়েছে ফিলিস্তিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর জোট ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি)। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই (বাংলাদেশ সময়) এক বিবৃতিতে এই ঘোষণা দিয়েছে এফএফসি। বলা হয়, ইতালি ও ফ্রান্সের পতাকাবাহী দুটি নৌযান ২৫ সেপ্টেম্বর ইতালির ওৎরান্তো বন্দর থেকে গাজার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বর নৌকা দুটি ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আরও ৮টি নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করা ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা’র যুক্ত হয়েছে কনসায়েন্সের সঙ্গে। মোট ১১টি জাহাজের বহর নিয়ে দল দুটি একসঙ্গে ছুটে চলেছে গাজা অভিমুখে। তবে নতুন এই বহরটি ত্রাণবাহী নয়। নৌযানে থাকা প্রত্যেকেই সাংবাদিক আর চিকিৎসক। ১১টি নৌযানে প্রায় ১০০ জন স্বেচ্ছাসেবী ও ক্রু আছেন। ফ্রিডম ফ্লোটিলা ফাউন্ডেশন, গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা, মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা এবং সুমুদ নুসানতারা-এই চার সংগঠনের জোট এফএফসির এই পরিকল্পনাটি ছিল গাজামুখী যাত্রার ‘প্লান-বি’। ৩১ আগস্ট গাজায় খাদ্য, ওষুধবাহী নৌবহর পাঠানোর ঘোষণা দেয় এফএফসি জোট। মিশনের নাম দেওয়া হয় ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’। সুইডেনের নাগরিক এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি ও রাজনীতিবিদ মান্ডলা ম্যান্ডেলাও অংশ নেন যাত্রায়। সে সময় তাদের এই বিকল্প পরিকল্পনাটি হয়। এমন কিছুই যে হবে তা আগেই অনুমান করেছিলেন তারা। খোলা চোখে তাদের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও বাস্তবিক অর্থে তারা সফল। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ওই হামলা কাঁপিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরও একবার নতুন করে জেগে উঠেছে বিশ্ববিবেক। দেশে দেশে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। পুলিশি লাঠিচার্জে সহিংস বিক্ষোভও হয়েছে কিছু দেশে। ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে রাস্তায় নেমেছে জনগণ। প্রতিবাদকারীরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়েছেন। এমনকি বৃহস্পতিবার ইউরোপের কিছু দেশে বিক্ষোভকারীরা যান চলাচল বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি দোকানপাটে ভাঙচুরও চালান তারা। বার্সেলোনায় প্রায় ১৫ হাজার বিক্ষোভকারী একসঙ্গে মিছিল করেন। তাদের স্লোগান ছিল-‘গাজা, তুমি একা নও’, ‘ইসরাইল বয়কট করো’ এবং ‘ফিলিস্তিনের স্বাধীন’। ইসরাইলকে সাহায্য করায় বার্সেলোনায় কফি চেইন স্টারবাকস, হ্যামবার্গার ফ্র্যাঞ্চাইজি বার্গার কিং এবং সুপারমার্কেট চেইন ক্যারেফোরসহ দোকান ও রেস্তোরাঁর জানালা ভেঙে ফেলা হয়। স্প্যানিশ টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে, পুলিশের বাধা অতিক্রমকারী বিক্ষোভকারীদের জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আয়ারল্যান্ডের সংসদের বাইরেও কয়েকশ বিক্ষোভকারী জড়ো হয়েছিল। সেখানে এক বিক্ষোভকারী মরিয়ম ম্যাকনালির মেয়েও সেই নৌবহরে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার মেয়ের জন্য উদ্বিগ্ন, কিন্তু সে যা করছে তা নিয়ে আমি খুব গর্বিত। গুরুতর বিপদের মুখে সে মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে।’ প্যারিসে প্লেস দে লা রিপাবলিকে প্রায় এক হাজার বিক্ষোভকারী দেখা গেছে। অন্যদিকে মার্সেইতে অস্ত্র প্রস্তুতকারক ইউরোলিংকসের প্রবেশপথ অবরোধের চেষ্টা করার সময় প্রায় ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতালিতে প্রধান ইউনিয়নগুলো নৌবহরের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সেখানে প্রধান শহরগুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশের মতে, শুধু রোমেই ১০ হাজার জন অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিচ্ছিলেন-‘আমরা সবকিছু অবরুদ্ধ করতে প্রস্তুত। গণহত্যা যন্ত্রটি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।’ ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ইতালির শিক্ষার্থীরা মিলানের স্ট্যাটালে এবং রোমের লা সাপিয়েঞ্জাসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দখল করেছে। সে সময় গাড়ির টায়ার ব্যবহার করে বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রোমে দ্বিতীয় দিনের বিক্ষোভে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। ইউএসবি এবং সিএফআইএল ইউনিয়নের ডাকা এই ধর্মঘটের ফলে বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ দেখা দেয়। শুক্রবার সকালে রোমে বিক্ষোভকারীরা টার্মিনির কেন্দ্রীয় ট্রেন স্টেশনে আবার জড়ো হতে শুরু করে। সিজিআইএল ইউনিয়নের প্রধান মাউরিজিও ল্যান্ডিনি রেডিও আনচিওকে বলেন, এই বিক্ষোভে মানুষ দেখাচ্ছে মানবতা ও দৃঢ়তা। বিক্ষোভের মূল উদ্দেশ্য হলো গাজায় চলমান গণহত্যা বন্ধ করা। তিনি বলেন, সরকার ও রাষ্ট্রগুলো যেখানে চুপ আছে বা দায় এড়াচ্ছে, সাধারণ মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছে। এএফপির খবরে বলা হযেছে , ইতালির বিভিন্ন শহরে এদিন বিক্ষোভ করে দুই লাখেরও বেশি মানুষ।
এছাড়া বার্লিন, হেগ, তিউনিস, ব্রাসিলিয়া, বুয়েনস আইরেস, সিডনি এবং ইস্তাম্বুলে আরও বিক্ষোভ হয়েছে। ব্রাসেলসে প্রায় ৩ হাজার মানুষ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন। সেখানে ধোঁয়া বোমা এবং আতশবাজির মধ্য দিয়ে ইইউকে ‘অবরোধ ভাঙার’ আহ্বান জানিয়েছিল। কুয়ালালামপুরে শুক্রবার বৃষ্টির মধ্যেও ছাতা মাথায় রাস্তায় নামেন আন্দোলনকারীরা। এমনকি ইসরাইলের ‘গডফাদার’ যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতেও দেখা গেছে বিক্ষোভ। যানবাহন অবরোধ করে মিছিল করেন ক্ষুব্ধ মার্কিনিরা।
৪ অধিকারকর্মীকে নিজে দেশে ফেরত : গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক ইতালির চারজন অধিকারকর্মীকে ফেরত পাঠিয়েছে ইসরাইল। শুক্রবার ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘অন্যদেরও ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।’ গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার এক বিবৃতিতে এদিন জানানো হয়, ইসরাইলের অভিযানে আটক অগণিত মানবাধিকারকর্মী অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন শুরু করেছেন।









































