ইরানি বিমানে মার্কিন হামলা ‘ভুল’ নয়, হিসাব কষা যুদ্ধাপরাধ

আজ ৩৭ বছর আগের এই দিনে অর্থাৎ ফার্সি ১৩৬৭ সালের ১২ তারিখ (১৯৮৮ সালের ৩ জুলাই) ইরানের আকাশে সংঘটিত হয় ইতিহাসের এক ভয়াবহ বিমান হামলা। পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালিতে অবস্থান করা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ভিনসেন্স দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ‘ইরান এয়ার’র ফ্লাইট ৬৫৫ যাত্রীবাহী বিমান লক্ষ্য করে। বিমানটি ইরানের বন্দর আব্বাস থেকে দুবাইয়ের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্বের একটি বাণিজ্যিক রুটে।

কীভাবে ঘটেছিল এই নারকীয় ঘটনা?

সকাল ১০টা ৪৭ মিনিটে বিমানটি উড্ডয়ন করে এবং মাত্র ৭ মিনিট পর সকাল ১০টা ৫৪-তে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আকাশেই বিস্ফোরিত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এতে বিমানের ২৯০ আরোহী নিহত হন। এর মধ্যে ৬৬ শিশু, ৫৩ নারী এবং ৪৬ জন বিদেশি নাগরিক ছিলেন। এ ঘটনা শুধু একটি বিমান দুর্ঘটনা নয়-এটি একটি যুদ্ধাপরাধ, যা আজও ইতিহাসে রক্তাক্ত স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।

‘ভুল’ নাকি পরিকল্পিত যুদ্ধাপরাধ?

হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, তারা ভেবেছিল বিমানটি একটি ইরানি এফ-১৪ যুদ্ধবিমান, যেটি ইউএসএস ভিনসেন্সের দিকে হামলা চালাতে আসছিল। তারা বলে যে, বিমানটি ৭ বার তাদের রেডিও সতর্কতা উপেক্ষা করেছিল এবং আক্রমণাÍকভাবে নিচে নামছিল। কিন্তু এই দাবি শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।

ফ্লাইট ৬৫৫ আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত বাণিজ্যিক রুট ‘অসনবৎ ৫৬’ দিয়ে চলছিল। এটি ট্রান্সপন্ডার সিগন্যাল পাঠাচ্ছিল এবং বিমানটি উচ্চতায় উঠছিল, নেমে আসছিল না। ভিনসেন্স যুদ্ধজাহাজের আধুনিক অবমরং রাডার ও সেন্সর দিয়ে সহজেই এটি বেসামরিক বিমান কিনা তা শনাক্ত করা সম্ভব ছিল।

পরে জানা যায়, জাহাজের অপারেটর প্রথমে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার আদেশ মানতে অস্বীকার করেনÑকারণ তার কাছে পরিষ্কার ছিল এটি কোনো যুদ্ধবিমান নয়। কিন্তু তাকে সামরিক শাস্তির ভয় দেখানো হলে, আদেশ কার্যকর করা হয়।

হামলার নেপথ্যে ইরান-ইরাক যুদ্ধ

ঘটনার পেছনে ছিল একটি বড় রাজনৈতিক ও সামরিক প্রেক্ষাপট। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চলছিল ইরান-ইরাক যুদ্ধ। তখন ইরাকের নেতৃত্বে থাকা সাদ্দাম হোসেনকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিচ্ছিল। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সাদ্দাম বাহিনী যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখনই ইরানকে কৌশলগতভাবে চাপে রাখতে হরমুজ প্রণালিতে যুক্তরাষ্ট্র মোতায়েন করে তাদের আধুনিক যুদ্ধজাহাজ। সাদ্দাম বাহিনীকে রক্ষা করতেই ইরানি ওই যাত্রীবাহী বিমানটি ভূপাতিত করা হয় বলে ইরান সরকার দাবি করে।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা

তৎকালীন শহীদ ফাউন্ডেশনের হরমুজগান শাখার প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম গোলাম আলী আরজমান্দ বলেনÑসেই দিনগুলো ছিল খুবই কষ্টকর। আমরা শিশুদের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখেছি। এটা শুধু একটি জাতীয় বিপর্যয় নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ।

আরজমান্দ বলেন, সেনাবাহিনী, বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ১৫ দিন ধরে সমুদ্র থেকে শহীদদের দেহ তুলে আনা হয়। প্রতিদিনই তাদের দেহ দেখতে গিয়ে হƒদয় বিদীর্ণ হয়ে যেত। একজন শহীদ মা বিস্ফোরণের পরও তার শিশুকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেনÑএই দৃশ্য মৃত্যু ও মায়ের ভালোবাসার এক অলঙ্ঘ্য বন্ধনের চিত্র তুলে ধরে। কিছু পরিবারে একসঙ্গে ৫-৭ জন শহীদ হনÑ তাদের দুঃখ, হতাশা ও ক্ষোভ ছিল সীমাহীন। আরজমন্দ বলেন, পানিতে পড়ে থাকার ফলে অনেক দেহ ফুলে ওঠে, কেউ কেউ ২০০-৩০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে যায়, যা শনাক্তকরণ এবং দাফনের কাজকে জটিল করে তোলে। তবুও, সহানুভূতিপূর্ণ ও সতর্ক ব্যবস্থাপনায় সম্মানের সঙ্গে শহীদদের দাফন সম্পন্ন হয় বলে তিনি জানান।

মার্কিন গণমাধ্যমের চাতুরালি

ফ্লাইট ৬৫৫ ধ্বংসের পর মার্কিন ও পশ্চিমা গণমাধ্যম এই ঘটনার ব্যাখ্যায় একই ভাষা ব্যবহার করে-‘দুঃখজনক ভুল’, ‘আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ’, ‘একটি মানবিক ট্র্যাজেডি’। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস ৪ জুলাই ১৯৮৮ সালের এক প্রতিবেদনেও দাবি করে, ‘ভুলক্রমে বিমানটিকে এ-১৪ যুদ্ধবিমান ভেবে হামলা চালানো হয়েছে’, যদিও তা বাণিজ্যিক রুটে ছিল। ওয়াশিংটন পোস্ট একই দিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বারবার বলে, ‘বিমানটি কোনো সতর্ক বার্তায় সাড়া দেয়নি’, ‘শত্রু’ ভেবে আঘাত হানা হয়েছিল’। বছরের পর বছর ধরে এই ভাষা দিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম পাঠকদের বিবেককে শান্ত রাখে, যেন একটি হত্যাযজ্ঞ ধীরে ধীরে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ‘দুর্ঘটনা’ হয়ে যায়।

সত্য উদ্ঘাটনের পরও দায় অস্বীকার 

যুক্তরাষ্ট্র কখনো এই ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার করেনি। বরং, ইউএসএস ভিনসেন্সের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন উইলিয়াম রজার্সকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ ‘লিজিয়ন অব মেরিট’ পুরস্কার দেওয়া হয়। বহু বছর পর, ২০২০ সালে ফরেন পলিসি এক রিপোর্টে স্বীকার করে বিমানটি ১৩ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় আন্তর্জাতিক রুটে স্বাভাবিক গতিতে উড়ছিল। বিমানটিতে এ-১৪ যুদ্ধবিমানের কোনো রাডার সংকেত ছিল না, বরং এটি একটি স্বাভাবিক বাণিজ্যিক ফ্লাইট ছিল।

ফরেন পলিসি আরও লেখে, তথ্য ভুলভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল এবং সিদ্ধান্তটি ছিল তড়িঘড়ি করে নেওয়া। এ ঘটনাটি যুদ্ধের কুয়াশা বা ‘ফগ অব ওয়ার’র প্রতিফলন। অর্থাৎ, চাপ, বিভ্রান্তি ও ভুল তথ্যের সমন্বয়ে ঘটেছে ‘ভুল সিদ্ধান্ত’।

দ্বিচারিতা ও ভণ্ডামি

১৯৮৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভুলবশত দক্ষিণ কোরিয়ার একটি যাত্রীবাহী বিমান (কেএএল ০০৭) গুলি করে ভূপাতিত করে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তখন একে সন্ত্রাসবাদ বলে নিন্দা করেন। তিনি বলেন, কোনো ভুল একটি নিরস্ত্র যাত্রীবাহী বিমানের ধ্বংসযজ্ঞকে বৈধতা দিতে পারে না। অথচ নিজ দেশের একই ধরনের ঘটনার পর সেই রিগ্যানই এটিকে ‘প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ’ বলে আখ্যা দেন।

স্মৃতি থেকে প্রতিরোধ, শোক থেকে শক্তি 

ফ্লাইট ৬৫৫ শুধু একটি বিমান ধ্বংসের ঘটনা নয়Ñএটি একটি জাতির হৃদয়ে গেঁথে থাকা ক্ষত, যে ক্ষতের প্রতিটি কণা আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতার সাক্ষ্য দেয়। শহীদদের পরিবার এখনো সেদিনের রক্তাক্ত স্মৃতি বুকে বয়ে বেড়ায়, কিন্তু শোকের ছায়া থেকে উঠে এসেছে প্রতিরোধের দীপ্ত আলো।

এই শহীদ পরিবারগুলোর সন্তানরা শুধু কান্না নিয়ে বেড়ে ওঠেনি। তারা শোককে শক্তিতে রূপান্তর করেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়েছে। তাদের প্রতিটি উচ্চারণে এখন ধ্বনিত হয় ন্যায়বিচারের দাবি এবং তাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে গাথা ‘মৃত্যু নয়, প্রতিরোধ’-এই চেতনা।

ফার্সি ১২ তারিখ (৩ জুলাই) এখন সত্য, সাহস ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনার প্রতীক। ইতিহাসের পাতা যতই পেছনে গড়ায়, ফ্লাইট ৬৫৫-এর শহীদদের স্মৃতি ততই গভীরভাবে জেগে থাকে ইরানিদের জাতীয় চেতনায় অমর প্রতীক হয়ে।  

LEAVE A REPLY