রূপপুর প্রকল্প ও জোড়া সেতুতে পর্যটক সমাগম

প্যারিসের আইফেল টাওয়ার এবং ভারতের হাওড়া ব্রিজ লোহার যে ধরনের স্ট্রাকচারে তৈরি ঠিক একইভাবে লোহার স্ট্রাকচারে তৈরি পাবনার পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বা রেল সেতু। আইফেল টাওয়ার এবং হাওড়া ব্রিজ দেখতে পর্যটকরা সেখানে যান। প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে হার্ডিঞ্জ ব্রিজেও বিপুলসংখ্যক পর্যটক সমাগম সম্ভব। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মাপাড়ের পাকশীতে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে। এ পর্যটন কেন্দ্র থেকে সরকারের প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতে পারে। ১১৫ বছর আগে পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত রেল সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সড়ক সেতু লালন শাহ সেতু পদ্মার পূর্বপাড়ে পাকশীতে মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এ জোড়া সেতুর পাশে পদ্মাপাড়ের মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের স্থাপনা পাকশীর সৌন্দর্যকে আরও দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। ইতঃপূর্বে লালন শাহ সেতু প্রকল্প থেকে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এসব ছাড়াও পদ্মা নদীর পাড়ে পাকশীর অদূরে প্রতিষ্ঠিত ঈশ্বরদী ইপিজেড, বন্ধ হয়ে যাওয়া পাকশী পেপার মিল, ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন, সবুজে বেষ্টিত পশ্চিম রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়, বন্ধ হয়ে যাওয়া ঈশ্বরদী বিমানবন্দর, ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, আঞ্চলিক কৃষি গবেষা কেন্দ্র, রেশম গবেষণাসহ অনেক স্থাপনা এ অঞ্চলকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। 

প্রতিদিন শত শত মানুষ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর পাদদেশে পাকশীর মনোরম দৃশ্য দেখতে আসেন। বর্ষায় জোড়া সেতুর নিচে নৌকায় এবং শীত মৌসুমে সেতুর নিচে শুকিয়ে যাওয়ায় পদ্মার বুকে ঘুরে বেড়ান। পাকশী লালন শাহ সেতু নির্মাণের সময় এখানে বেশ কিছু অত্যাধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। রয়েছে আবাসিক কোয়ার্টার, সুইমিংপুল, খেলার মাঠ, গার্ডেন, সকাল-বিকাল ভ্রমণের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও বিনোদন কেন্দ্র। এতকিছু থাকার পরও কোনো কিছুই কাজে লাগানো হচ্ছে না। অথচ এসব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে সরকারকে বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। 

সূত্র মতে, পদ্মা নদীর পূর্ব পাড়ে গড়ে ওঠা পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা ব্রিটিশ আমল থেকে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পদ্মা নদীর সাঁড়াঘাটে গড়ে ওঠে নদী বন্দর। ১৯১০ সালে এই সাঁড়াঘাটের আনুমানিক দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে পাকশীতে পদ্মা নদীর ওপর দেশের বৃহত্তম স্থাপনা রেলওয়ে সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। এ জন্য অনেকের কাছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সাঁড়ার ব্রিজ নামেও পরিচিত। এই ব্রিজের ৩০০ মিটার ভাটিতে উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য ২০০৪ সালে ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক সেতু নির্মিত হয়। যার নাম রাখা হয়েছে লালন শাহ সেতু। এ সেতুটিও যমুনা সেতুর পরে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম সড়ক সেতু। লালন শাহ সেতু ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পাশাপাশি নির্মিত হওয়ায় এখানকার সৌন্দর্য অনেক বেড়ে গেছে। 

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, কয়েকশ বছর আগে থেকেই ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে পদ্মাপাড়ের পাকশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এজন্যই ব্রিটিশরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার জন্য জায়গাটি বেছে নেয়। এখানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, পশ্চিম রেলের বিভাগীয় অফিস, রেলওয়ে জংশন স্থাপন করা হয়। আবার পাকিস্তান আমলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এবং বিমানবন্দর এ পদ্মাপাড়েই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ইপিজেডসহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ এলাকার গুরুত্ব অনুযায়ী গড়ে তোলা হয়।

পাকশীকে বিনোদন স্পট করার জন্য দুই দশক আগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এগিয়ে আসেন এলাকার শিল্পপতি প্রয়াত আকরাম আলী খান সঞ্জু। তিনি সর্বপ্রথম গড়ে তোলেন আধুনিকমানের পাকশী রিসোর্ট। এছাড়া পদ্মা নদীর বাম তীর অর্থাৎ সেতুর পূর্বপাড়ের দক্ষিণ দিকে বিভিন্ন বৃক্ষরাজি দ্বারা আধুনিক পদ্ধতিতে বনায়ন তৈরি করা হয়েছে। যা যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। পাকশী এমনই ভৌগোলিক স্থানে অবস্থিত যে, উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল তথা রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের মাঝামাঝি স্থানে। এখান থেকে উত্তরাঞ্চলের পাবনা ছাড়াও নাটোর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া এবং দক্ষিণাঞ্চলের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও যশোর জেলার রেল এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। কাজেই পদ্মা নদীর তীরবর্তী পাকশী দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

LEAVE A REPLY